Friday, 13 February 2015

মাতৃভাষায় মহান আল্লাহর কথা

undefined
পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। পড় তোমার প্রতিপালক বড়ই মহান। যিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন কলম দিয়ে। মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না। (সূরা আলাক ১ থেকে ৫ আয়াত)। হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূলের কাছে নাজিলকৃত প্রথম দিনে নাজিল হয়। কোরআনের এ পাঁচটি আয়াতে আল্লাহ মানব জাতির জন্য তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানের মূল্যের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্যকে অত্যন্ত সুন্দর ও স্বচ্ছভাবে তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাঁর বাণীকে পাঠ করতে বলেছেন শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের অর্থাৎ অজানাকে জানার জন্য। তিনি স্পষ্টই বলে দিয়েছেন অজানাকে জানার নামই হচ্ছে শিক্ষা। তাই বলেছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না। শিক্ষার এমন প্রাঞ্জল ও চমৎকার সংজ্ঞা আল্লাহ ছাড়া কে বা দিতে পারে। শিক্ষার সঙ্গে কলমের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি তাঁর লওহে মাহফুজে কলম দিয়েই তো মানুষের জন্য তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানকে সংরক্ষণ (লিপিবদ্ধ) করেছেন। মানব জাতির জন্য তার শ্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শিক্ষাসহ সব ধরনের শিক্ষাই কল্যাণের মূল। শিক্ষার আলো মধ্য দিনের সূর্যালোকের চেয়েও উজ্জ্বল। আল্লাহর শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো না থাকলে মানব জাতি আজও ডুবে থাকত আঁধারেই। এ আঁধারের বন্দি ও বন্দিনীদের আলোতে ডেকে নেয়ার জন্যই তিনি (আল্লাহ) কোরআনের সূরা কামারের ১৭, ২২, ৩২ ও ৪০ আয়াতে কত সুন্দর ও স্বচ্ছভাবেই না আহ্বান করেছেন। তিনি বলেন, অবশ্যই আমি উপদেশ গ্রহণের (শিক্ষার) জন্য কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, আছে কি কেউ এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার? সুতরাং হে মুমিন মুসলমানরা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিন, কোরআন পাঠ, শ্রবণ ও কণ্ঠস্থ করুন এবং অপরকে পাঠ করে শোনান তা শিক্ষার জন্য, অজানাকে জানার জন্য অর্থাৎ জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান বিতরণের জন্য, তাঁর উপদেশ গ্রহণের জন্য। যেন তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানালোয় পাঠক, শ্রতাদের হৃদয় আলোকিত হয়, আর সেই আলোতে জগৎ উৎভাসিত হয়। তাঁর শিক্ষার পূর্ব শর্ত হচ্ছে বোধগম্য ভাষা। তাই বোধের ভাষায় কোরআন পড়ুন।

 এ জগতে শিক্ষাই সব কল্যাণের মূল। শিক্ষার মতো মহামূল্যবান সম্পদ ও ঐশ্বর্য আর নেই। শিক্ষার মতো কল্যাণকর কিছুও নেই। তাইতো কোরআন নামের মহাজ্ঞানভাণ্ডার রাসূলুল্লাহকে উপহার দিয়েই আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই আপনাকে দিয়েছি কল্যাণের প্রাচুর্য (ইন্না আ তাইনা কাল কাউসার)। আর আল্লাহর বান্দাদের জন্য আল্লাহর শিক্ষা ও জ্ঞানের মতো মহামূল্যবান, গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয়, তাৎপর্যপূর্ণ ও কল্যাণের কিছুই নেই। তাইতো রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে কোরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষার কথাই বলেছেন, না বুঝেও আরবি ভাষা আওড়ানোর কথা বলেননি। বরং মানুষ যদি নিজ নিজ ভাষা বা মাতৃভাষায় আল্লাহর কথা বুঝতে ও জানতে পারে তাই হচ্ছে শিক্ষা। আর ভাষা বুঝতে পারলেই তাতে মানুষ তাঁর উপদেশ পাবে, যে উপদেশ তিনি কোরআনে তুলে ধরেছেন তাঁর বান্দাদের শিক্ষার জন্য। আর শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদান হচ্ছে মতৃভাষা বা জাতিসত্তার ভাষা। যা এ পৃথিবীর প্রতিটি জাতির প্রতিটি মানুষ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে। পৃথিবীর এমন কি কেউ আছে যে, তার মাতৃভাষা বুঝে না? স্বয়ং আল্লাহর দৃষ্টিতেই বান্দাদের মাতৃভাষা তাঁর ইবাদতের সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম ও সর্বাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ভাষা। বোধগম্য শক্তির মানদণ্ডেই তার এ শ্রেষ্ঠত্ব ও যোগ্যতা অর্জন। তাইতো আল্লাহতায়ালা রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে যেমন তাঁর মাতৃষাভা ও জাতিসত্তার ভাষায় কিতাব নাজিল করেছেন ঠিক তেমনি করেই তাঁর সব অনারব নবী-রাসূলদের ভাষায় (নিজ নিজ জাতিসত্তার ভাষায়) তাঁরই বিভিন্ন কিতাব নাজিল করে পৃথিবীর বাস্তবতায় অকাট্যভাবে প্রমাণ করে দিয়েছেন, বান্দাদের মাতৃভাষাই তাঁর কিতাবের শিক্ষা এবং তাঁর ইবাদতের সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম, সর্বাধিক যোগ্যাতসম্পন্ন তাঁর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় ভাষা। মাতৃভাষাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভাষা। এ ভাষার মহীমা কোনোদিনও শেষ হবে না। শেষ হওয়ার নয়। এ ভাষার আলো কখনোই ম্লান হবে না। তিনি নিজেই তো তাঁর শিক্ষাকে আরবি ভাষার প্রাচীরে রুদ্ধ করেননি। বরং সব ভাষার জন্য মুক্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহর ইবাদতের জন্য যদি আরবি ভাষাই অপরিহার্য হতো তবে কেন তিনি তাওরাত, ইনজিল, জাবুরসহ অন্যান্য কিতাব বিভিন্ন অনারবি ভাষায় নাজিল করলেন। কেনইবা ঈসা, মুসা, দাউদের (আ.) মাতৃভাষায় নাজিল করলেন? আল্লাহ তাঁর শিক্ষা ও জ্ঞানের মূল্যায়নের জন্যই বান্দাদের মাতৃভাষার মূল্যায়ন করছেন যেন সবাই তাদের আপনাপন ভাষাতে আল্লাহর কথা বুঝতে পারে, তাতে উপদেশ পায়, তা শিখতে পারে ও জানতে পারে। তিনি তাঁর শিক্ষাকে, উপদেশকে ও জ্ঞানকে মুক্ত করে দিয়েছেন সব জাতির ভাষাতে। তিনি কোনো রাসূলকেই মাতৃভাষার বিকল্প পথ দেখাননি। কেননা মাতৃভাষা একমাত্র প্রাকৃতিক বোধগম্য ভাষা। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ভাষা। আর আল্লাহ পাক প্রাকৃতিকভাবে যা কিছু মানুষকে দিয়েছেন তার মতো নিখাদ বা খাঁটি কিছুই নেই। উত্তম ও কল্যাণকর কিছুই নেই। তাই নিঃসংকোচে বলে যাই আরবি ভাষার প্রাচীরে রুদ্ধ করে অনারব জাতিদের কখনোই কোরআনের আলোয় আলোকিত করা যাবে না। তারা আঁধারেই বন্দি ও বন্দিনী হয়ে জীবন কাটিয়ে যাবে। এ বিশ্ব থেকে অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার কখনোই দূর হবে না। অজ্ঞতার সুযোগ্য ধর্মব্যবসা আরও জমজমাট হবে। ধর্মব্যবসায়ী ধর্মবেত্তারা দিকে দিকে ক্ষমতা দখলের জন্য ধর্মের পরিবেশকে আরও বৈরী করে তুলবে, মানুষের দুর্দশা-দুর্ভোগের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকবে না। সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকবে না, ধর্মের ফেরিওয়ালাদের কারণে। সুন্নি-শিয়ার দ্বন্দ্বে আল্লাহর সব মসজিদও রক্তগঙ্গায় ভাসছে। জঙ্গিবাদ তো ধর্মবাণিজ্যের কৌশল মাত্র। সরল প্রাচীন মানুষকে অজ্ঞতার সুযোগ শিকারি বানানোর কৌশল। এর হাত থেকে মুক্তির জন্যই কোরআনসহ ধর্মের শিক্ষাকে মুক্ত করতে হবে। একটা কথা সর্বদাই স্মরণ রাখতে হবে, শিক্ষা ও সচেতনতাই সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিরোধ। অজ্ঞতা ও বিজাতির ভাষার অন্ধকারে ডুবে থেকে কখনোই বিশ্ববাসীর মুক্তি ও শান্তি মিলবে না। আর অনারবদের ধর্মীয় শিক্ষার পথ রুদ্ধ থাকলে শুধু আরবদের শিক্ষা দিয়ে বিশ্ব চলবে না। সারা বিশ্বের অবস্থা আজ যেমন সংকটাকির্ণ। কেবল আল্লাহর ভয় ও শিক্ষাই পারে এর থেকে বিশ্বমানবতার মুক্তি ও শান্তির পথ দেখাতে। তাইত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান সাধকের মৃত্যু নেই।’ জ্ঞানের পথে আসে মুক্তি।

দ্বীন ইসলামের প্রচলিত শিক্ষা নীতি অনারব জাতিতে উদ্ভট ভাষানীতি নিয়ে চলছে। বোধগম্যহীন আরবি ভাষায় শিক্ষা ও শিক্ষা বিস্তারের নামে প্রতারণামূলক শিক্ষা চলছে। বোধগম্যহীন ভাষা আওড়িয়ে শিক্ষা বিস্তারের নামে অমারাত্রির অন্ধকারের মতো অজ্ঞতার অন্ধকারের বিস্তারই চলছে। শিক্ষার পূর্ব শর্তই হচ্ছে বোধগম্য ভাষা। যে ভাষা মানুষ বুঝে না ও যে কথা মানুষ জানতে পারে না তা শিক্ষা নয়। তাই বোধগম্যহীন ভাষা শিক্ষা ও জ্ঞানের ভাষা নয়। তা জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষার অযোগ্য ভাষা। আল্লাহর ইবাদত ও শিক্ষা অর্থাৎ ধর্মচর্চা ও ধর্মাচার হতে হবে জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে। আল্লাহর কাছে শিক্ষা ও জ্ঞানের মূল্য সর্বাধিক। তাইতো রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলেম (শিক্ষা বা জ্ঞান) তালাশ করতে পথ চলে আল্লাহ তার জন্য বেহেশতের পথ সুগম করে দেন। (বুখারি হাদিস-২৬৪৭)। এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জ্ঞান অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর ফেরেশতারাও পাখা নামিয়ে দেয়। আসমানে যা কিছু আছে, জমিনে যা কিছু আছে এমনকি পানির মৎস্যরা পর্যন্ত তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করে। (বুখারি হাদিস-২৬৮২)। আজ সব জাতির ভাষাতে কোরআন-হাদিসের শিক্ষা ও জ্ঞানের মুক্তি চাই।

© মাহমুদা আক্তার নীনা