ভাষার বৈচিত্র্য ও মাতৃভাষা চর্চা : প্রেক্ষিত ইসলাম
তর্কশাস্ত্রের ভাষায় বাক ও বোধশক্তিসম্পন্ন প্রাণীকে মানুষ বলা হয়। মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ভূষিত হওয়ার পেছনে বাক ও বোধশক্তির ক্ষমতা এবং ভাষাগত দক্ষতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা, যা বাকসংকেতে রূপায়িত হয়ে সমাজের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করে। প্রকৃতিগত এ ভাষাগত দক্ষতা ও সক্ষমতার কারণেই শিশুরা অল্প বয়সেই ভাষা শেখার প্রক্রিয়া আত্মস্থ করতে পারে। বংশগতভাবে ভাষাজ্ঞান আহরণ, ভাব বিনিময় ও বাক্যব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে বলে বধির শিশুরা প্রতীকী ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও অনুরূপ দক্ষতা দেখায়। ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন। কেবল সাংকেতিক ধ্বনির নামই ভাষা নয়; মানব মনের ভাব-আবেগ অনুভূতি চিন্তা ও কল্পনা-জল্পনার অনুবাদই ভাষার কাজ। তাই মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির ভাষা অর্থহীন। প্রতিটি দেশ, শহর ও অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। সাধারণ অর্থে মায়ের মুখ থেকে বাল্যকাল থেকে যে ভাষা শিক্ষা করা হয়, তা-ই মাতৃভাষা। ব্যাপক অর্থে স্বজাতির ভাষাই মাতৃভাষা। বাঙালি জাতির জন্য বাংলাই মাতৃভাষা। ভৌগোলিক, আঞ্চলিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। শাশ্বত, জীবন্ত ও চিরন্তন ধর্ম ইসলামেও মাতৃভাষায় জ্ঞান আহরণ, মাতৃভাষার চেতনা লালন ও সাহিত্যপূর্ণ বিশুদ্ধ শব্দ উচ্চারণে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ভাষার বৈচিত্র্য স্রষ্টার বিস্ময়কর নিদর্শন ও বিশেষ নিয়ামত : যে শিশুটি নিজ হাতে খাওয়ার শক্তি রাখে না, এমনকি শক্ত খাবার গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে না, আধো আধো বুলি দিয়ে সে শিশুই খুবই দ্রুত ভাষাকে রপ্ত করে ফেলে। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে হাঁটতে শেখার সঙ্গে ভাষাকেও সে শিখে নেয়। শিশুর কোমল সত্তায় এ শক্তি কে সঞ্চার করল? নিশ্চয়ই মহা ক্ষমতাবান আল্লাহ। যিনি সুবিশাল মাটির স্তূপে পতিত বীজের মধ্য থেকে সুন্দর, প্রকাণ্ড ও মহা-উপকারী বৃক্ষ বের করে নিয়ে আসেন। যিনি ডিম থেকে বাচ্চা, বীর্য থেকে সন্তান, বীজ থেকে বৃক্ষ- জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন। 'আর তুমিই জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে বের করো'- (সুরা আলে ইমরান : ২৭)। ভাব প্রকাশক ভাষা সে স্রষ্টারই দান। তাঁরই ভাষায় শুনুন- 'করুণাময় আল্লাহ! শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানবপ্রাণ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা-বয়ান'- (সুরা আর-রাহমান: ১-৪)। সাধারণ মানুষকে তিনি ভাষা শিখিয়েছেন পরোক্ষভাবে, শক্তি সঞ্চার করে। কিন্তু মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে তিনি এ ভাষা শিখিয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে, অকৃত্রিম উপায়ে। আল্লাহ বলেন, 'আর আল্লাহ আদমকে শিখালেন সব বস্তুসামগ্রীর নাম'- (সুরা বাকারা : ৩১) ভাব প্রকাশের মৌখিক পদ্ধতি ছাড়াও রয়েছে লিখিত পদ্ধতি। সে পদ্ধতিটিও আল্লাহর শেখানো। আল্লাহ বলেন, 'পড়ো, তোমার প্রভু মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন'- (সুরা আলাক : ৩-৪)। লক্ষণীয় যে উল্লিখিত আয়াতগুলোতে কোথাও কোনো বিশেষ ভাষার কথা বলা হয়নি। তাই সব ভাষাই আল্লাহর নিয়ামত। আদি পিতা আদমের সন্তান হয়েও মানুষের যেমনি গোত্র-গাত্রবর্ণ, স্বর ও সুরের রুক্ষতা-কোমলতা ও দেহের উচ্চতা ও খর্বতা রয়েছে তেমনি রয়েছে ভাষার ভিন্নতাও। ইথনোলোগ (Ethnologoue) নামের ভাষা বিশ্বাকোষের হিসাব মতে, পৃথিবীর মোট ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯)। বিবিসির তথ্যমতে, পৃথিবীর ভাষা সংখ্যা ৭,০০০। এশিয়ায় ২২০০ ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। (সূত্র : www.bbc.uk.languages/guide/languages.shtml) বৈচিত্র্য ভাষার সমাহার স্রষ্টার অপার বিস্ময়কর নিদর্শন। কেবল ভাষাই নয়; একই ভাষাভাষীর মধ্যে পৃথক ধ্বনি ও স্বর লক্ষ করা যায়। চেহারা না দেখেও কেবল আওয়াজ শুনেই মানুষকে চেনা যায় ধ্বনির ভিন্নতার কারণে। এসবই আল্লাহর দান। 'আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য'- (সুরা রুম : ১২)
ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার তাগিদ : হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, বন্ধুতা-বৈরিতা, আশা-নিরাশা ও ঘৃণা-ভালোবাসার সব কিছুই প্রকাশ করে মাতৃভাষা। ছন্দের গাঁথুনিতে, ভাষার লালিত্যে শব্দসৈনিক ও ভাষাশিল্পীদের যে নৈপুণ্য ও কুশলতা, তা মাতৃভাষায়ই সহজ-সাবলীলভাবে উপস্থাপন সম্ভব। মনের ভাব ব্যক্ত করার জন্য মাতৃভাষা সর্বোত্তম পথ, পন্থা ও পদ্ধতি। তাই যুগে যুগে নবী-রাসুলদের পাঠানো হয়েছে স্বজাতির ভাষাভাষী করে। আল্লাহ বলেন, 'আমি সব রাসুলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন'- (সুরা ইবরাহিম : ৪)। ইসলামের দাওয়াত ও ধর্মপ্রচারে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বক্তৃতা ও বাগ্মিতার রয়েছে সম্মোহনী শক্তি। রয়েছে কারো হৃদয় জয় করার, কাউকে মুগ্ধ-আবিষ্ট করার আশ্চর্য ক্ষমতা।
একটি কালজয়ী বক্তৃতা, একটি সফল বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। তাই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে হজরত মূসা (আ.) ভাষিক জড়তা দূর হওয়ার জন্য দোয়া করেছেন। বলেছেন, 'হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন।' তিনি আরো বলেন, 'হে আমার রব, আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে'- (সুরা ত্বা-হা : ২৫-২৮)।
শুধু তাই নয়; খোদাদ্রোহী ফেরাউনের কাছে অমোঘ সত্যের বাণী পৌঁছানোর জন্য তিনি তাঁর বাগ্মী, স্পষ্টভাষী ভাই হারুন (আ.)-এর সহযোগিতা চেয়েছেন। 'আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে বাগ্মী। তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন। সে আমাকে সমর্থন করবে'- (সুরা আল কাসাস : ৩৪)। শুভেচ্ছামূলক, কোমল ও সবলীল ভাষা কারো জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই ঐশী নির্দেশ এসেছে, 'তোমার পালনকর্তার পথে আহ্বান করো, প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে। আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পন্থায়'- (সুরা নাহল : ১২৫)।
বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব : কেবল মাতৃভাষা গ্রহণই নয়; ভাষাটি শিল্পমানসম্পন্ন হওয়াও শরিয়তের কাম্য। রাসুল (সা.) ভাষার বিশুদ্ধতা, উপযুক্ত শব্দচয়নের প্রতি বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজেও সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী ছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি আরবের সবচেয়ে বাগ্মী। তা ছাড়া আমি বিশুদ্ধভাষী কোরাইশের বংশধর। একদিন এক সাহাবি দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বললেন, 'আ-আলিজু?' প্রবেশ করার অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার আরবিতে রয়েছে। কিন্তু প্রমিত ও সাহিত্যপূর্ণ শব্দ হলো 'আ-আদখুলু'?- আমি কি প্রবেশ করব? রাসুল (সা.) তাঁকে শেষোক্ত শব্দটি প্রয়োগ করতে বলেছেন। ভাষার মানোন্নয়নে ও ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে আঞ্চলিক ভাষা ও ভিন্ন ভাষার শব্দ গ্রহণ দোষনীয় নয়। কিন্তু সেটি যদি শব্দ সন্ত্রাস ও ভাষিক আগ্রাসনের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, কোনো ভাষার জন্য তা মোটেও মঙ্গলজনক নয়। এশার নামাজকে বিদ্রূপ করে কাফিররা 'আতামা' বলত। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা আতামা বলো না, 'এশা' বলো। শব্দসন্ত্রাস নির্মূলের শিক্ষা কোরআনেও দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে মুমিনগণ, তোমরা (কাফিরদের ন্যায় নবীকে ব্যঙ্গ করে) 'রায়িনা' (আমাদের রাখাল) বলো না। তোমরা 'উনজুরনা' (আমাদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন) শব্দটি ব্যবহার করো'- (সুরা বাকারা : ১০৪)। হিন্দি সিরিয়াল ও ইংলিশ মিডিয়ামের এ যুগে বাংলাভাষীদের জন্য উল্লিখিত আয়াতে বিশেষ শিক্ষা রয়েছে।
ভাষিক সৌজন্যবোধ ও ইসলাম : ইসলাম কেবল বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেনি; বরং গালাগাল, ব্যঙ্গাত্মক ও কটুবাক্য ব্যবহারে নিষেধ করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'তোমরা তাদের গালি দিও না, আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের উপাসনা করে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখিয়ে অজ্ঞাতবশত আল্লাহকে গালি দেবে'- (সুরা আনআম : ১০৮)। কাউকে উপহাস করা, অপমানিত করা, ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ বলেন, 'মুমিনগণ, কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে.....তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না'- (সুরা হুজরাত : ১১)। কারো সঙ্গে অহেতুক ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া ইসলাম পছন্দ করে না। অগত্যা যদি কারো সঙ্গে বিতর্ক করতে হয়, তথাপি ভাষিক সৌজন্যবোধ বিসর্জন দেওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন, 'তোমরা আহলে কিতাবের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করবে না; অগত্যা যদি করতে হয়, তবে উৎকৃষ্ট পন্থায় করবে'- (সুরা আনকাবুত : ৪৬)। প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য; ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার বাহক হোক না কেন, তার সঙ্গেও সৌজন্যমূলক আচরণ ও শুভেচ্ছাসূচক বিনম্র উচ্চারণ ইসলামী দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। হজরত মুসা ও হারুন (আ.)-কে ফেরাউনের কাছে পাঠিয়ে এ বিশেষ হেদায়েতই দেওয়া হয়েছিল। 'অতঃপর তোমরা তাকে কোমল কথা বলো, হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে।' (সুরা ত্বহা)। রাসুল (সা.) ছিলেন মিষ্টভাষী। জীবনে কাউকে তিনি একটি কটুবাক্যও বলেননি। হাদিস শরিফে এসেছে, 'রাসুল (সা.) গালাগালকারী, অশ্লীলভাষী ছিলেন না।' হাদিসে মুনাফিকের অন্যতম নিদর্শন বলা হয়েছে, 'যখন সে বিবাদে লিপ্ত হয়, সীমালঙ্ঘন করে কদর্য ভাষা ব্যবহার করে' (বোখারি : ২৩২৭)
প্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষাও শিখতে হবে : একটি ভিনদেশি ভাষা পর্যটকের জন্য একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ন্যায়ই কাজে আসতে পারে। তা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু মুক্তা-মানিক্য, রত্নভাণ্ডার ভিনদেশি ভাষায়ও পাওয়া যায়। বর্তমানে শিক্ষা-দীক্ষা, তথ্যসম্ভার ও বৈশ্বিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আর এ বিষয়টিকেও ইসলাম নিরুৎসাহিত করেনি। রাসুল (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-কে ইহুদিদের 'ইবরানি' ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি মাত্র ১৫ দিনে তা আত্মস্থ ও কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। মুফতি রশিদ আহমদ গঙ্গুহি (রহ.) লিখেছেন, 'ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করা বৈধ।' (ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, পৃ. ৫৭৪)। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসেম নানুতবি (রহ.) শেষ জীবনে ইচ্ছা পোষণ করেছেন, 'আমি যদি ইংরেজি ভাষা জানতাম, তাহলে ইউরোপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘোষণা দিতাম যে, তোমরা যাকে জ্ঞান মনে করো, তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং জ্ঞান হলো যা নবীদের সিনা থেকে বের হয়ে আলোকিত হৃদয়গুলোতে অবস্থান নিয়েছে।' (মাসিক আর রশিদ, উর্দু, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪)। আরবি একটি জীবন্ত ভাষা। সাহিত্যবিচারেও এ ভাষার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। কোরআন সুন্নাহর ভাষা আরবি। তাই আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্ব মুসলিমের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, ঘনিষ্ঠ ও হৃদয়ঘটিত। সুতরাং আরবি ভাষা জ্ঞান অর্জন করাও মুসলমানদের অন্যতম কর্তব্য। এ ছাড়াও পার্থিব-অপার্থিব যেকোনো প্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। আর মাতৃভাষার প্রতি মমতা- সেতো মায়ের শেখানো বুলি থেকেই নিঃসরিত ও আহরিত এক প্রাণস্পন্দন। যা আজ বিশ্বের সব ভাষার মানুষকে একই সম্মান ও মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
ভাষার বৈচিত্র্য স্রষ্টার বিস্ময়কর নিদর্শন ও বিশেষ নিয়ামত : যে শিশুটি নিজ হাতে খাওয়ার শক্তি রাখে না, এমনকি শক্ত খাবার গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে না, আধো আধো বুলি দিয়ে সে শিশুই খুবই দ্রুত ভাষাকে রপ্ত করে ফেলে। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে হাঁটতে শেখার সঙ্গে ভাষাকেও সে শিখে নেয়। শিশুর কোমল সত্তায় এ শক্তি কে সঞ্চার করল? নিশ্চয়ই মহা ক্ষমতাবান আল্লাহ। যিনি সুবিশাল মাটির স্তূপে পতিত বীজের মধ্য থেকে সুন্দর, প্রকাণ্ড ও মহা-উপকারী বৃক্ষ বের করে নিয়ে আসেন। যিনি ডিম থেকে বাচ্চা, বীর্য থেকে সন্তান, বীজ থেকে বৃক্ষ- জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন। 'আর তুমিই জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে বের করো'- (সুরা আলে ইমরান : ২৭)। ভাব প্রকাশক ভাষা সে স্রষ্টারই দান। তাঁরই ভাষায় শুনুন- 'করুণাময় আল্লাহ! শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানবপ্রাণ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা-বয়ান'- (সুরা আর-রাহমান: ১-৪)। সাধারণ মানুষকে তিনি ভাষা শিখিয়েছেন পরোক্ষভাবে, শক্তি সঞ্চার করে। কিন্তু মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে তিনি এ ভাষা শিখিয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে, অকৃত্রিম উপায়ে। আল্লাহ বলেন, 'আর আল্লাহ আদমকে শিখালেন সব বস্তুসামগ্রীর নাম'- (সুরা বাকারা : ৩১) ভাব প্রকাশের মৌখিক পদ্ধতি ছাড়াও রয়েছে লিখিত পদ্ধতি। সে পদ্ধতিটিও আল্লাহর শেখানো। আল্লাহ বলেন, 'পড়ো, তোমার প্রভু মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন'- (সুরা আলাক : ৩-৪)। লক্ষণীয় যে উল্লিখিত আয়াতগুলোতে কোথাও কোনো বিশেষ ভাষার কথা বলা হয়নি। তাই সব ভাষাই আল্লাহর নিয়ামত। আদি পিতা আদমের সন্তান হয়েও মানুষের যেমনি গোত্র-গাত্রবর্ণ, স্বর ও সুরের রুক্ষতা-কোমলতা ও দেহের উচ্চতা ও খর্বতা রয়েছে তেমনি রয়েছে ভাষার ভিন্নতাও। ইথনোলোগ (Ethnologoue) নামের ভাষা বিশ্বাকোষের হিসাব মতে, পৃথিবীর মোট ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯)। বিবিসির তথ্যমতে, পৃথিবীর ভাষা সংখ্যা ৭,০০০। এশিয়ায় ২২০০ ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। (সূত্র : www.bbc.uk.languages/guide/languages.shtml) বৈচিত্র্য ভাষার সমাহার স্রষ্টার অপার বিস্ময়কর নিদর্শন। কেবল ভাষাই নয়; একই ভাষাভাষীর মধ্যে পৃথক ধ্বনি ও স্বর লক্ষ করা যায়। চেহারা না দেখেও কেবল আওয়াজ শুনেই মানুষকে চেনা যায় ধ্বনির ভিন্নতার কারণে। এসবই আল্লাহর দান। 'আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য'- (সুরা রুম : ১২)
ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার তাগিদ : হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, বন্ধুতা-বৈরিতা, আশা-নিরাশা ও ঘৃণা-ভালোবাসার সব কিছুই প্রকাশ করে মাতৃভাষা। ছন্দের গাঁথুনিতে, ভাষার লালিত্যে শব্দসৈনিক ও ভাষাশিল্পীদের যে নৈপুণ্য ও কুশলতা, তা মাতৃভাষায়ই সহজ-সাবলীলভাবে উপস্থাপন সম্ভব। মনের ভাব ব্যক্ত করার জন্য মাতৃভাষা সর্বোত্তম পথ, পন্থা ও পদ্ধতি। তাই যুগে যুগে নবী-রাসুলদের পাঠানো হয়েছে স্বজাতির ভাষাভাষী করে। আল্লাহ বলেন, 'আমি সব রাসুলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন'- (সুরা ইবরাহিম : ৪)। ইসলামের দাওয়াত ও ধর্মপ্রচারে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বক্তৃতা ও বাগ্মিতার রয়েছে সম্মোহনী শক্তি। রয়েছে কারো হৃদয় জয় করার, কাউকে মুগ্ধ-আবিষ্ট করার আশ্চর্য ক্ষমতা।
একটি কালজয়ী বক্তৃতা, একটি সফল বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। তাই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে হজরত মূসা (আ.) ভাষিক জড়তা দূর হওয়ার জন্য দোয়া করেছেন। বলেছেন, 'হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন।' তিনি আরো বলেন, 'হে আমার রব, আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে'- (সুরা ত্বা-হা : ২৫-২৮)।
শুধু তাই নয়; খোদাদ্রোহী ফেরাউনের কাছে অমোঘ সত্যের বাণী পৌঁছানোর জন্য তিনি তাঁর বাগ্মী, স্পষ্টভাষী ভাই হারুন (আ.)-এর সহযোগিতা চেয়েছেন। 'আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে বাগ্মী। তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন। সে আমাকে সমর্থন করবে'- (সুরা আল কাসাস : ৩৪)। শুভেচ্ছামূলক, কোমল ও সবলীল ভাষা কারো জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই ঐশী নির্দেশ এসেছে, 'তোমার পালনকর্তার পথে আহ্বান করো, প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে। আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পন্থায়'- (সুরা নাহল : ১২৫)।
বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের গুরুত্ব : কেবল মাতৃভাষা গ্রহণই নয়; ভাষাটি শিল্পমানসম্পন্ন হওয়াও শরিয়তের কাম্য। রাসুল (সা.) ভাষার বিশুদ্ধতা, উপযুক্ত শব্দচয়নের প্রতি বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজেও সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী ছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি আরবের সবচেয়ে বাগ্মী। তা ছাড়া আমি বিশুদ্ধভাষী কোরাইশের বংশধর। একদিন এক সাহাবি দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বললেন, 'আ-আলিজু?' প্রবেশ করার অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার আরবিতে রয়েছে। কিন্তু প্রমিত ও সাহিত্যপূর্ণ শব্দ হলো 'আ-আদখুলু'?- আমি কি প্রবেশ করব? রাসুল (সা.) তাঁকে শেষোক্ত শব্দটি প্রয়োগ করতে বলেছেন। ভাষার মানোন্নয়নে ও ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে আঞ্চলিক ভাষা ও ভিন্ন ভাষার শব্দ গ্রহণ দোষনীয় নয়। কিন্তু সেটি যদি শব্দ সন্ত্রাস ও ভাষিক আগ্রাসনের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, কোনো ভাষার জন্য তা মোটেও মঙ্গলজনক নয়। এশার নামাজকে বিদ্রূপ করে কাফিররা 'আতামা' বলত। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা আতামা বলো না, 'এশা' বলো। শব্দসন্ত্রাস নির্মূলের শিক্ষা কোরআনেও দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে মুমিনগণ, তোমরা (কাফিরদের ন্যায় নবীকে ব্যঙ্গ করে) 'রায়িনা' (আমাদের রাখাল) বলো না। তোমরা 'উনজুরনা' (আমাদের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন) শব্দটি ব্যবহার করো'- (সুরা বাকারা : ১০৪)। হিন্দি সিরিয়াল ও ইংলিশ মিডিয়ামের এ যুগে বাংলাভাষীদের জন্য উল্লিখিত আয়াতে বিশেষ শিক্ষা রয়েছে।
ভাষিক সৌজন্যবোধ ও ইসলাম : ইসলাম কেবল বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেনি; বরং গালাগাল, ব্যঙ্গাত্মক ও কটুবাক্য ব্যবহারে নিষেধ করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, 'তোমরা তাদের গালি দিও না, আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের উপাসনা করে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখিয়ে অজ্ঞাতবশত আল্লাহকে গালি দেবে'- (সুরা আনআম : ১০৮)। কাউকে উপহাস করা, অপমানিত করা, ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ বলেন, 'মুমিনগণ, কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে.....তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না'- (সুরা হুজরাত : ১১)। কারো সঙ্গে অহেতুক ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া ইসলাম পছন্দ করে না। অগত্যা যদি কারো সঙ্গে বিতর্ক করতে হয়, তথাপি ভাষিক সৌজন্যবোধ বিসর্জন দেওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন, 'তোমরা আহলে কিতাবের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করবে না; অগত্যা যদি করতে হয়, তবে উৎকৃষ্ট পন্থায় করবে'- (সুরা আনকাবুত : ৪৬)। প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য; ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার বাহক হোক না কেন, তার সঙ্গেও সৌজন্যমূলক আচরণ ও শুভেচ্ছাসূচক বিনম্র উচ্চারণ ইসলামী দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। হজরত মুসা ও হারুন (আ.)-কে ফেরাউনের কাছে পাঠিয়ে এ বিশেষ হেদায়েতই দেওয়া হয়েছিল। 'অতঃপর তোমরা তাকে কোমল কথা বলো, হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে।' (সুরা ত্বহা)। রাসুল (সা.) ছিলেন মিষ্টভাষী। জীবনে কাউকে তিনি একটি কটুবাক্যও বলেননি। হাদিস শরিফে এসেছে, 'রাসুল (সা.) গালাগালকারী, অশ্লীলভাষী ছিলেন না।' হাদিসে মুনাফিকের অন্যতম নিদর্শন বলা হয়েছে, 'যখন সে বিবাদে লিপ্ত হয়, সীমালঙ্ঘন করে কদর্য ভাষা ব্যবহার করে' (বোখারি : ২৩২৭)
প্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষাও শিখতে হবে : একটি ভিনদেশি ভাষা পর্যটকের জন্য একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ন্যায়ই কাজে আসতে পারে। তা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু মুক্তা-মানিক্য, রত্নভাণ্ডার ভিনদেশি ভাষায়ও পাওয়া যায়। বর্তমানে শিক্ষা-দীক্ষা, তথ্যসম্ভার ও বৈশ্বিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আর এ বিষয়টিকেও ইসলাম নিরুৎসাহিত করেনি। রাসুল (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-কে ইহুদিদের 'ইবরানি' ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি মাত্র ১৫ দিনে তা আত্মস্থ ও কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। মুফতি রশিদ আহমদ গঙ্গুহি (রহ.) লিখেছেন, 'ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করা বৈধ।' (ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, পৃ. ৫৭৪)। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাসেম নানুতবি (রহ.) শেষ জীবনে ইচ্ছা পোষণ করেছেন, 'আমি যদি ইংরেজি ভাষা জানতাম, তাহলে ইউরোপের পাণ্ডিত্যের দাবিদারদের সামনে ঘোষণা দিতাম যে, তোমরা যাকে জ্ঞান মনে করো, তা আদৌ জ্ঞান নয়; বরং জ্ঞান হলো যা নবীদের সিনা থেকে বের হয়ে আলোকিত হৃদয়গুলোতে অবস্থান নিয়েছে।' (মাসিক আর রশিদ, উর্দু, দারুল উলুম দেওবন্দ সংখ্যা, পৃ. ১৬৪)। আরবি একটি জীবন্ত ভাষা। সাহিত্যবিচারেও এ ভাষার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। কোরআন সুন্নাহর ভাষা আরবি। তাই আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্ব মুসলিমের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, ঘনিষ্ঠ ও হৃদয়ঘটিত। সুতরাং আরবি ভাষা জ্ঞান অর্জন করাও মুসলমানদের অন্যতম কর্তব্য। এ ছাড়াও পার্থিব-অপার্থিব যেকোনো প্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। আর মাতৃভাষার প্রতি মমতা- সেতো মায়ের শেখানো বুলি থেকেই নিঃসরিত ও আহরিত এক প্রাণস্পন্দন। যা আজ বিশ্বের সব ভাষার মানুষকে একই সম্মান ও মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
লেখক : সিইও, সেন্টার ফর ইসলামিক ইকোনমিক্স বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা।
ahmanictg@gmail.com