Sunday, 15 February 2015

ভাষা আল্লাহ তায়ালার এক মহান নিয়ামত

ইসলাম এমন এক পরিপূর্ণ বিধান, যেখানে রাষ্ট্রনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ এ রকম হাজারো বিষয় আলোচিত হয়েছে। সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও যৌক্তিকসম্মত আলোচনা রয়েছে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা বিষয়ে। বলা হয়েছে, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা ও ভাব প্রকাশের কলাকৌশল। [সুরা আর রাহমান : ১-৪]। এতে বোঝা যায়, ভাষা সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত এক মহা নেয়ামত। মহান আল্লাহর সঙ্গে মনপ্রাণ খুলে কথা বলে তার সানি্নধ্য লাভের উপায় এ ভাষা। মাতৃভাষায় একজন মানুষ যত সহজে তার স ষ্টার কাছে মনে ভাব প্রকাশ করতে পারে অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ বলেছেন, 'তুমি বুদ্ধিমত্তা ও উত্তম পদ্ধতিতে মানুষকে তোমার প্রভুর দিকে আহ্বান করো।' এ কারণে যুগে যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যত নবী-রাসুল, অলি আল্লাহর আগমন ঘটেছে, তাঁরা সবাই তদাঞ্চলের ভাষা আয়ত্তের বিষয়ে সজাগ ছিলেন।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাজার হাজার ভাষাভাষী মানুষ। এক জরিপে দেখা যায়, বর্তমান পৃথিবীতে ছয় হাজারের মতো ভাষা আছে। এসব ভাষার মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ ভাষা অর্থাৎ শ তিনেক ভাষা দিয়েই পৃথিবীর ৯৬ শতাংশ মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে চলেছে। এর মধ্যে বাংলা অন্যতম ভাষা এবং বিশ্বের প্রায় ২৩০ মিলিয়ন মানুষ বাংলায় কথা বলছে। বিশ্বজুড়ে ভাষার এই বৈচিত্র্যতা রাব্বুল আলামিনের কুদরতের অপূর্ব নিদর্শনই বটে। কোরআনুল কারিমে সে বৈচিত্র্যতার কথাই বিধৃত হয়েছে : আর তাঁর নিদর্শনাবলির অন্যতম নিদর্শন হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণবৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন। [সুরা- রুম : ২২]

কাজেই আল্লাহ পাকের কালাম ও রাসুল (সা.)-এর অসংখ্য হাদিস দ্বারা এটি প্রমাণিত যে, দেশে দেশে ভাষাগত বৈচিত্র্যতা ইসলাম বা মুসলমানদের জন্য কোনো অন্তরায় নয়, বরং এর দ্বারা পারস্পরিক পরিচিতি সহজ হয়। এ কারণে আল্লামা যামাখশারী বলেন, 'এ ধরনের ভাষাগত ভিন্নতার মাধ্যমেই পরস্পরের পরিচিতি ঘটে, সব কণ্ঠস্বর ও রং যদি এক হয়ে যেত, তাহলে মানুষ পরস্পরকে ভুলে যেত ও মিশ্রণজনিত জটিলতা সৃষ্টি হতো এবং বহু কল্যাণকর বিষয় অচল হয়ে যেত।' [প্রাগুক্ত] প্রখ্যাত তাফসিরকারক মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.)-এর একটি উক্তিও এখানে প্রণিধানযোগ্য : 'ভাষার মূল প্রণেতা আল্লাহই। অতঃপর সৃষ্টির নানা প্রকার ব্যবহারের ফলে তা বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে এবং বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব হয়েছে। আমাদের ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কণ্ঠেও একই কথা ধ্বনিত হয়- 'মানুষের স্বভাবের মধ্যে যদি ভাষার বীজ না থাকত, তাহলে ভাষার অস্তিত্ব সম্ভবত মানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত না। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সঙ্গেই তার মধ্যে ভাষার বীজ রেখে দিয়েছিলেন। এদিক থেকে ভাষাকে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব দান বলা যেতে পারে।'

এটি ইসলাম স্বীকৃত যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষের যেকোনো ভাষায় কথা বলা তার স্বভাবজাত, জন্মগত, সর্বজনীন এবং আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার। কোনো অঞ্চলের, কোনো জাতির মাতৃভাষার ওপর হস্তক্ষেপ করা আল্লাহর দেওয়া কোরআনিক বিধানেরই লঙ্ঘন, যেমনটি করেছিল পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকরা। উর্দুভাষী শাসকগোষ্ঠী আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সামান্যতম উদারতা দেখায়নি, বরং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালিদের ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানিয়ে দিয়েছিলেন- Urdu and Urdu shall be the state language of Pakistan। তখন দম্ভোক্তিকারী ওই মুসলমান (?) শাসকটি ভুলে গিয়েছিল ইসলামের এ বাণীর কথা- 'তোমরা অন্যায়ভাবে কারো ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করো না, কারো ওপর অত্যাচার ও জুলুম করো না। আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না।'

পাকিস্তানিরা মনে করেছিল, বাংলা ভাষাকে চিরতরে মুছে দিয়ে বাঙালিদের স্তব্ধ করা যাবে এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই প্রান্তের মানুষকে মুসলিম ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করা যাবে। কিন্তু প্রকৃত ইসলামের দৃপ্ত কণ্ঠ ঘোষণা হলো : মুসলমান কিংবা ইসলাম কোনো ভাষাগত ব্যাপার নয়, বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্যের বিষয়। এ আনুগত্য যেকোনো ভাষায় প্রকাশ করা যেতে পারে। রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব ভাষা জানেন। [বোখারি : কিতাবুল জিহাদ]।

শুধু বাংলা ভাষা নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো ভাষার প্রতি ইসলাম যে মর্যাদা দিয়েছে সে ব্যাপারে পাকিস্তানের মুসলিম (?) শাসকগোষ্ঠী মোটেও ওয়াকিবহাল ছিল না। তাই বাংলাভাষী মুসলমানদের ওপর 'হিন্দুত্বের' অপবাদ চাপাতে গিয়ে নিজেরাই আল্লাহর কোরআন ও রাসুল (সা.)-এর হাদিস লঙ্ঘন করে চরম অমুসলমানিত্বের পরিচয় দিয়েছে।
লেখক : মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন, সাবেক কলেজ শিক্ষক (অর্থনীতি)
বর্তমানে ঢাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত