Sunday, 1 February 2015

ধর্ম নিয়ে তামাশা করা ঠিক নয়

ফ্রান্সের পত্রিকা শার্লি হেবদো ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করার জন্য পরিচিত। শুধু একবার নয় বহুবার এ পত্রিকার কার্টুনিস্টরা ধর্ম ও নবী-রাসূলদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। এটা নাকি তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। একটি বা একাধিক ধর্মকে নিয়ে কৌতুক ও বিদ্রুপ করা এবং কোটি কোটি মানুষের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ও মহাপুরুষদের নিয়ে ক্যারিকেচার ও কার্টুন আঁকা কী ধরনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা যা বিবেকবান মানুষের জন্য অসহ্য ও বেদনাদায়ক, এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। কোনো ধর্মেই অন্য ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্য করার অনুমোদন নেই। বরং তা অপরাধ হিসেবে গণ্য।

শার্লি হেবদো মহানবী (সা.)-এর কার্টুন একে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে আঘাত দিয়েছে। তারা বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এ ন্যক্কারজনক কাজ করে যাচ্ছে। অথচ প্রগতিশীল বিশ্ব তাদের এ কাজকে নিন্দা না জানিয়ে প্যারিসের কার্যালয়ে ৭ জানুয়ারি হামলার ঘটনাকে জঙ্গি তৎপরতা বলে পত্রিকার কার্টুনিস্টদের উৎসাহিত করেছে। ফলে দেখা গেল পত্রিকাটির নতুন সংখ্যাটি ছাপা হয়েছে ৩০ লাখ। যেখানে তাদের নিয়মিত প্রচার সংখ্যা ৬০ হাজার এবং নতুন সংখ্যার প্রচ্ছদে আবারও মহানবী (সা.)-এর কার্টুন ছেপেছে। এর শিরোনাম হিসেবে লেখা রয়েছে, ‘সবকিছু ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।’

ইহুদি কার্টুনিস্টদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ এ আচরণ মুসলমানদের জন্য চরম অবমাননাকর ও উসকানিমূলক। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যত দিন মুসলিম জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে থাকবে ততদিন এ জাতি পরাজিত হবে না। মহানবী (সা.)-এর মর্যাদা এতই ওপরে যে সামান্য কার্টুনে তা ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।

ধর্ম নিয়ে তামাশা করার অধিকার কারও নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। পারস্পরিক সহাবস্থান, সহমর্মিতা ও সহনশীলতার ধর্ম। এ ধর্মের নির্দেশ হল, ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন।’ অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার কাছে আর আমারটা আমার। (সূরা কাফিরুন, আয়াত-৬) তাছাড়া আল কোরআনে সূরা আল বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই।’ মুসলমানদের উচিত আল কোরআনের এসব নির্দেশ পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের মাধ্যমে বিশ্বময় শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলা। মুসলমানের নামে যে অপবাদ, দুর্নাম ও ভীতি বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা দূর করার মাধ্যমে ইসলামের অপূর্ব সৌরভ ও গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য সুখ, শান্তির ব্যবস্থা করেনি, বরং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে সুস্থভাবে, নিরাপত্তার সঙ্গে বাঁচার নিশ্চয়তা বিধান করেছে। যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি জুলুম করা হয়, তাহলে স্বয়ং রাসূল (সা.) জালেমদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করবেন বলে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে।

তাছাড়া অমুসলিম কিতাবধারীদের (ইহুদি ও খ্রিস্টান) প্রতি উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ আল কোরআনে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে অমুসলিম কিতাবধারীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করবে না, করলে করবে উত্তম পন্থায়, তবে তাদের সঙ্গে নয় যারা তাদের মধ্যে বে-ইনসাফ, এবং বল আমাদের প্রতি ও তাদের প্রতি যা নাজিল করা হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য একই এবং আমরা তারই আজ্ঞাবহ। (সূরা : আন কাবুত, আয়াত-৪৬)

এই আয়াতে ইসলামের অহিংস ও শান্তির বার্তা পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। যা প্রমাণ করে ইসলামের মতো উদার ও শান্তিপ্রিয় ধর্ম আর নেই। আয়াতের মর্মার্থে এটাই বুঝানো হয়েছে মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদি ভাই ভাই, কারও সঙ্গে কারও কোনো ঝগড়া বিবাদ নেই।

সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতি, ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবৈষম্যের ঊর্ধ্বে থেকে মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে হবে। এর অভাবে শুরু হয় মানুষের মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি। আজকের বিশ্বে যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এসবের অবসান করে মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের রব একজন। তোমাদের আদি পিতা একজন। প্রত্যেকেই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি। আল্লাহতায়ালা পারস্পরিক পরিচিতির সুবিধার্থে বিভিন্ন সমাজ ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছেন। আরবের ওপর যেমন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তেমনি অনারবের ওপর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই আরবের। একইভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের আর কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব বা বৈশিষ্ট্য নেই। শ্রেষ্ঠত্ব, বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার একমাত্র ভিত্তি হল তাকওয়া তথা আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে।’

মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর নির্দেশ যথাযথ অনুসরণ করলে ইসলামের বিজয় একসময় হবে এটা নিশ্চিত। জ্ঞান ও উত্তম আদর্শের বলেই সে বিজয় সূচিত হবে। আদর্শ বিচ্যুত হলে কিংবা আবেগতাড়িত অবিবেচনাপ্রসূত কাজ সে বিজয়কে বাধাগ্রস্ত করবে। মনে রাখতে হবে প্রত্যেক জাতি ও ধর্মাবলম্বীর রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ। বহুধাবিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় বহুদল-উপদল ও নানা মতের মানুষ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সংঘাত ও বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ নেই। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও সংঘাতের পথ বেছে নিও না। এই বাড়াবাড়ির ফলেই অতীতে বহু জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।’

তাই মুসলিম জাতিকে শিক্ষা-দীক্ষায় উজ্জীবিত হতে হবে। ইসলামের মূল বাণী উপলব্ধি করতে হবে। সে লক্ষ্যে সুফিবাদের জ্ঞান চর্চা বাড়াতে হবে। কেননা সুফিগণ সর্বাবস্থায় মানবতাবাদ ও শান্তির পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। ইসলামের পূর্ণ অনুসারী হিসেবে তারা হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, লোভ-লালসা, ভোগ-বিলাস, দখলদারিত্ব ভুলে পরস্পর প্রেম-ভালোবাসার বন্ধন গড়তে আগ্রহী। তাদের দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কোনো বৈষম্য নেই। তারা মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করেন। সব ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণী, গোষ্ঠীর মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখে। তারা নিজের স্বার্থ ভুলে মানুষের হিত সাধনে ব্রত।

বর্তমানে দেশ-বিদেশে সর্বত্র ইসলামের ছত্রছায়ায় যে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে এবং ইসলামের দুর্নাম বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সুফি সমাজকে সামনে এগিয়ে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। ইসলামের প্রকৃত অনুসারী, শান্তির ধারক-বাহক সুফিদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। 

লেখক : সৈয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন, প্রাবন্ধিক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও গদিনশীন পীর, দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফ, E-mail : ahmadinurisds@gmail.com, intlmoonsighting@gmail.com