Tuesday, 10 February 2015

মায়ের ভাষায় কর্ম মায়ের ভাষায় ধর্ম 



‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান’। কবির এ উক্তি কবি মনে উদ্ভাসিত নূরানি ইলহাম হলেও এর মর্ম বাণী আসমানি আয়াতের মতোই আমাদের কানে ও মনে ঝঙ্কৃত হয় এবং আসন গেঁড়ে বসে। তেমন হওয়াই আলো-বাতাসের মতো স্বাভাবিক। কারণ এসবেরই উৎস স্বয়ং পরম মেহেরবান রাহমানুর রাহিম। মাকেও তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং জান্নাতুল ফেরদাউসস্বরূপ এ মায়ের হৃদয় কুঠুরিতে তিনিই মায়ের ফসল শিশু সন্তানকে সৃষ্টি করেছেন।বেহেশতস্বরূপ এ মায়ের গর্ভে, বুকে ও কোলে এ শিশুর রুবুবিয়তের তথা লালন-পালনের যাবতীয় সুধা কুন-ফাইয়াকুনের মতোই সরবরাহ করেছেন দয়াময় মাবুদ মাওলা। শিশুকে মুখে বলতেও হয় না কুন! শিশুর নড়াচড়া ও অর্থহীন আওয়াজ বা শব্দেই ফাইয়াকুন হয়ে যায় বেহেশতের সরবরাহ সামগ্রী। আবার এ শিশু সন্তানের কানের কোমল পর্দায় অনবরত ঝঙ্কার তুলতে থাকে স্নেহময়ী মায়ের আদুরে বুলি মাতৃভাষা। মায়েরসম জান্নাত কোলে দোলেই শিশু বুকের সুধা পানের সঙ্গে সঙ্গে গিলতে থাকে মায়ের বুলি। বুকের ধন আর মুখের বুলি সমান তালে চলে শিশুর লালনে। বেহেশতের মালিক দয়াল রাহমান যে বুলিরও মালিক। তিনিই আল্লামাহুল বায়ান। মায়ের মুখের মধুর বয়ানই মাতৃভাষা। নিশ্চয়ই তা খোদার সেরা দান। সূরা আর-রাহমানের শুরুতেই দয়াময় রহমান ঘোষণা দিয়েছেন : কোরআন, ইনসান আর বয়ান তিনিই সৃষ্টি করেছেন। এই কোরআনই ধর্ম ও কর্ম। ইনসানই প্রেমপূর্ণ মানুষ যার সেরা মা। আর বয়ান হল মায়ের ভাষা- মাতৃভাষা। তাই তো আমাদের কবি স্বর্গীয় আনন্দে গেয়ে ওঠেন : ‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান’। এ সত্যকে কে অস্বীকার করতে পারে? এত বড় নেয়ামতকে কি অস্বীকার করা চলে? ফাবি আইয়ি আলায়ি রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান! রাব্বুল আলামীনের প্রেরিত কোনো নবী-রাসূলও তা করেননি। বরং মাতৃভাষায় তারা নিজ নিজ গোত্র ও জাতিকে ধর্ম ও কর্মের আসমানি শিক্ষা ও দীক্ষা দান করেছেন। আমাদের নবীজী রাহমাতুল্লিল আলামীন সর্বোত্তমভাবে মাতৃভাষা শিখেছেন এবং শিক্ষা দিয়েছেন। মাতৃকোলে ও মাতৃগৃহে সন্তান যে ভাষা শিখে তা তার অন্তর মর্মে সব সময়ের জন্য গেঁথে যায়। এ মাতৃভাষাতেই যারা ঘরের-বাইরে ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে উত্তমভাবে শিখে তারাই হতে পারে অনেক বড় মানুষ। মাতৃভাষার মাধ্যমে যারা মাতৃকোল থেকেই ধর্ম ও কর্মকে ভালোভাবে রপ্ত করে নেয় তারাই হয় জাতির শক্তি, মেরুদণ্ড, পুঁজি ও চালক। আর মাতৃভাষার নেয়ামতে সফল হয়েই জাতি হয় বিশ্ব মানসম্পন্ন ও বিশ্ব ধন্য। বড়ই আফসোসের বিষয় যে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি যত গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক ও জরুরি ছিল তা মোটেও করা হয়নি। যদি সামান্যতম গুরুত্বও মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ধর্মীয় নেতারা শুরু থেকেই প্রদর্শন করতেন তাহলে বায়ান্নে এবং একাত্তরে জাতির যুবক ও তরুণদের বুকের তাজা রক্ত এভাবে ঢালতে হতো না। আজ যে ধর্ম ও কর্মের মাঝে মারাত্মক বিভাজন ও বৈরিতা দেখা দিয়েছে তার জন্য দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা ও ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক নেতারা কম দায়ী নন। অথচ যেসব জাতির মাতৃভাষা আরবি ও ফার্সি তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতারা জগৎবিখ্যাত হয়ে আছেন নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চা করে। তাদের কর্ম ও ধর্ম মাতৃভাষাতেই সর্বোত্তমভাবে পালিত হয়েছে। হাফিজ, সাদী, আত্তার, রূমী, জামী, নিজামী, গাজ্জালী, বিরুনী, ইবনেসিনা, ইবনুল আরাবি, ফেরদৌসী প্রমুখ কালজয়ী মহাপুরুষরা নিজ নিজ মাতৃভাষায় অবদান রেখেই তো বিশ্ব সম্পদ হয়েছেন। তাহলে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় কেন এত ভয়াবহ অবহেলা করলেন আমাদের মুরব্বিরা? যদিও বর্তমান তরুণ ও যুব আলেমদের ভেতর মাতৃভাষা চর্চার তৎপরতা শুরু হয়েছে তথাপি এখনা দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্রগুলো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। মাতৃভাষার প্রতি এ জঘন্য আচরণ দ্বীন, ধর্ম, পেশা, কর্ম, জাতি ও উম্মাহর প্রতিই অজ্ঞতাপূর্ণ জাহেলী দুর্বলতা, যা জাতীয় ঈমান ও আমলের চরম ক্ষতিসাধন করেছে। মায়ের পায়ের তলায় বেহেশত থাকার অনস্বীকার্য হাদিসের মর্ম তো মায়ের ভাষাতেই প্রকাশিত ও প্রচার হতে পারত। যার ফলে আমাদের মাতৃভূমিটাও বেহেশতের বাগিচায় পরিণত হতো এবং আমরাও বাংলা মায়ের সন্তানেরা ধর্ম-কর্মের সঠিক দিশা পেয়ে দয়াময় মাবুদের স্নেহধন্য হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতাম নিশ্চিন্তে। দুর্নীতি, পাপাচার, পশ্চাৎপদতা, অবিশ্বাস ও হানাহানি এভাবে আমাদের ঘিরে ধরত না।

~ © মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান~
www.jugantor.com/islam-and-life/2014/02/14/68853#sthash.AMVUBKxu.dpuf