আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিস্তম্ভ। এশফিল্ড পার্ক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ২০০৬ সালে এর উদ্বোধন করা হয়
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ভাষা শিক্ষার ক্ষমতা প্রদান করেছেন। তবে স্থান-কাল-জাতিভেদে মানুষের ভাষা ব্যবহারের বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। এ বৈচিত্র্যের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে এবং মানবজাতির জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় নিদর্শন। আল্লাহ বলেছেন, 'আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম নিদর্শন আকাশ, পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।' (সূরা রোম : ২২)। পবিত্র কোরআনের এ আয়াতে সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই মানবজাতির মধ্যে ভাষার বৈচিত্র্য প্রদান করেছেন। আর আল্লাহ যেহেতু এমনটি চেয়েছেন, তাই পৃথিবীর যে কোনো ভাষাই আল্লাহর বিশেষ উদ্দেশ্যেরই বাহক বলা চলে। তাই কোনো ভাষাকেই অমর্যাদা করা সঙ্গত নয়। তবে এক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রাধান্য স্বীকৃত। যে ভাষা যার মাতৃভাষা বা জন্মসূত্রে যে ভাষা অর্জন করেন, তার কাছে সে ভাষাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করতে হবে। এর পরে অন্য ভাষার অবস্থান।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক তা হলো, মুসলমান হিসেবে আমাদের কাছে আরবি ভাষার গুরুত্ব থাকা উচিত কিনা। এক্ষেত্রে আমার বিবেচনা হচ্ছে, নিশ্চয়ই আমাদের কাছে আরবি ভাষা একান্ত জরুরি; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মাতৃভাষা বাংলাকে অগ্রাহ্য করে নয়। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে এ সমাজে যদি বসবাস করতে হয়, তাহলে বাংলাকে ভালো করে আয়ত্ত করা জরুরি বলে মনে হয়। মনে রাখা দরকার, ভাষা একটি মাধ্যম মাত্র। আল্লাহর ভাষা বলতে কিছু নেই। আবার আল্লাহর ভাষার বাইরেও কিছু নেই। আল্লাহ সব ভাষাই জানেন ও বোঝেন। যে ভাষাতেই তাকে ডাকা হোক না কেন তিনি তা শুনবেন।
বিশেষ কারণে আল্লাহ বিশেষ কোনো ভাষাতে তাঁর বাণী বা প্রত্যাদেশ প্রদান করেছেন। কোনো বিশেষ ভাষার প্রতি দুর্বলতার কারণে নয়। আল্লাহ সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই তাঁর বার্তাবাহক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেক রাসূলের কাছেই তাঁর তথ্য রাসূলের স্বজাতির ভাষায়ই কিতাব বা প্রত্যাদেশ প্রদান করেছেন। হজরত ঈসা (আ.) এর মাতৃভাষা ছিল হিব্রু এরামাইক। এসব দেশের এক ধরনের আঞ্চলিক ভাষা। তথাপি ওই আঞ্চলিক ভাষাতেই তার কাছে ইঞ্জিল কিতাব অবতীর্ণ হয়। আগেই বলেছি, ভাষার মূল কাজ হচ্ছে মনোভাব প্রকাশ করা। এটি একটি মাধ্যম। আল্লাহ তাঁর রাসূলদের কাছে তাঁর মনোভাব জানিয়েছেন। আল্লাহ পরম জ্ঞানী। তিনি সব ভাষা জানেন। কিন্তু মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। তাই মানব সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্য থেকে তাঁর মনোনীত প্রতিনিধির মাতৃভাষাতেই আল্লাহ তার সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। আল্লাহ তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি রাসূলের মাতৃভাষাতেই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন।
পবিত্র কোরআন আরবি ভাষায় কেন নাজিল হয়েছে, তার উত্তর স্বয়ং আল্লাহই প্রদান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (সা.) কে বলেন, 'আমি তোমার ভাষায় কোরআন সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি তার দ্বারা সাবধানিদের সুসংবাদ দিতে পারো ও তর্কপ্রিয় সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারো।' (সূরা মরিয়ম : ৯৭)।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাই কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। মুহাম্মদ (সা.) নিজে যদি না বুঝতেন তাহলে তিনি মানবজাতিকে তা বোঝাতে পারতেন না। নিজে বোঝার পরে প্রাথমিকভাবে তাঁর জাতিকে বা চার পাশের লোকজনকে বোঝানো প্রয়োজন। তাদের ভাষাও যেহেতু আরবি, তাই তাদের বোঝানোর জন্যও কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল হওয়ার দরকার ছিল। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, 'আমি যদি আজমি (অ-আরবি) ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করতাম, ওরা অবশ্যই বলতো এর আয়াতগুলো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হবে না কেন? কিতাবের ভাষা আজমি আর রাসূল আরবীয়'। (সূরা ফুসিলাত : ৪৪)
বস্তুত ইসলামের আদর্শ যদি বুঝতে হয় অথবা কাউকে বোঝাতে হয়, তাহলে সর্বপ্রথম তাকে তার মাতৃভাষাতেই তা বোঝা ও বোঝানো সুবিধাজনক।
লেখক : ড. মোঃ শওকত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়