Sunday, 15 February 2015

সুশীল সমাজ নয় প্রয়োজন গণমানুষের প্রতিরোধ

সুশীল সমাজ বলে একটি সমাজের কথা আজকাল প্রায় উচ্চারিত হয়। বোঝা যায় এই সমাজের অধিবাসী যারা তারা অতিশয় সুশীল। শব্দটি নিয়ে আমি খুব গোলক ধাঁধায় আছি। আভিধানিকভাবে ‘শীল’ হচ্ছে এর মৌলিক শব্দ। ‘শীল’ শব্দের অর্থ স্বভাব, আচার-আচরণ —এরকম। ‘সু’একটি বিশেষণ। শীলের সাথে যুক্ত হয়ে সত্ স্বভাব, সদাচারী, বিনয়ী এমন মানুষের প্রতিবিম্ব মনে ভাসে। ছেলেবেলায় বড়রা বেয়াড়াপনা না করে সুশীল হতে বলতেন। আমার কাছে তখন সুশীল বালকের ছবি এমন আঁঁকা ছিলো, ধোপ-দুরস্ত শার্ট-প্যান্ট পরা। তেল দেয়া মাথায় মায়ের বা বোনের হাতে সুন্দর সিঁথি কাটা আঁচড়ানো। কারো সাথে ঝগড়া-ঝাটি নেই। নীরবে স্কুলে যাওয়া আসা। বড়দের কথার অবাধ্য না হওয়া। শিক্ষকদের অতি আদরের—অমন একটি ছেলে।

বেশি আগের কথা নয়। সুশীল সমাজ কথাটি তখনো তেমন প্রচার পায়নি। শিক্ষিত, জ্ঞানচর্চার সাথে যুক্ত এক শ্রেণির মানুষকে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলার চল ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি আর লেখালেখিতে অভ্যাস আছে বলে জানলাম আমিও নাকি বুদ্ধিজীবী সমাজের অন্তর্ভুক্ত। এই সমাজের সদস্য করার আগে কেউ জানতে চায়নি আমার বুদ্ধিসুদ্ধি কতোটা আছে। প্রকৃত অর্থেই আমি বুদ্ধি বা জ্ঞান বিতরণ করেই জীবিকা নির্বাহ করি কিনা। সময়ে সময়ে তো অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়। তিন দশকেরও আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছি। তখন দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে তাকে খুব ভালো ফলাফলধারী হতে হতো। জ্ঞানচর্চা অর্থাত্ গবেষণায় নিবেদিত হওয়া আবশ্যক ছিলো। শিক্ষকতায় যোগ দেয়া বা পদোন্নতির জন্য গবেষণা প্রকাশনার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হতো। আমরা জানতাম শিক্ষকের দায়িত্ব জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সৃষ্টি এবং জ্ঞান বিতরণ। সেই অর্থে বুদ্ধিজীবী অভিধাটি খুব অপ্রাসঙ্গিক মনে হতো না। একইভাবে একজন ডাক্তারকেও বুদ্ধিজীবী ভাবতে কুণ্ঠা হয়নি। যখন দেখতাম চিকিত্সাবিজ্ঞান নিয়ে তিনি হর-হামেশা গবেষণা করছেন। দেশি-বিদেশি জার্নালের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখছেন। কিন্তু বিস্মিত হতাম সেই প্রতিভাবান কৃষককে দেখে যিনি নিজের মেধা খাটিয়ে মাজরা পোকা মারার দেশি উপায় বের করেছেন। জল সেচনের সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। নতুন জৈবসার উদ্ভাবন করে সফল হয়েছেন। অথচ এই প্রতিভাবান কৃষকটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠটি মাড়াননি কোনোদিন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী সমাজ তাদের সমাজে ঠাঁই দেননি এই কৃষকটিকে। পরে জানলাম এই অভিজাত বুদ্ধিজীবী সমাজকেই নাকি সুশীল সমাজ বলে। তাহলে মানতে হবে জ্ঞানচর্চার সাথে যুক্ত মহাত্মানরাই এখনকার ভাষায় সুশীল। কিন্তু এতে আমার চিন্তায় কিছু সংকট তৈরি হচ্ছে। ধরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিত্সক, সাংবাদিক সকলেই কি জ্ঞানচর্চার সাথে যুক্ত? এখন তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনীতির দাসত্বে বন্দি। শিক্ষক নিয়োগে এখন প্রার্থীর উজ্জ্বল ফলাফল আর গবেষণা প্রধান নয়। প্রধান হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচিতি। শোনা যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদের অর্থ বাণিজ্যও নাকি শিক্ষক পদলাভের পূর্বশর্ত এখন। এ ধারায় যারা শিক্ষক হচ্ছেন তাদের অনেকেই জ্ঞানচর্চা,  জ্ঞান সৃষ্টি আর জ্ঞান বিতরণের সময় তেমনটা পান না। তার বদলে রাজনীতিতে নিবেদিত শিক্ষকগুরুদের নির্দেশনা পালনে ব্যস্ত থাকেন বেশি। এতো খাটাখাটনির পর বিনোদনের দরকার পড়ে। তাই সন্ধ্যায় ক্লাবে ঢুকে রাত দশটায় বাড়ি ফেরেন। এতো ক্লান্তিতে আর গবেষণায় মন বসে না। বুদ্ধি বা জ্ঞানের চর্চা ঠিকঠাক না করে পদাধিকারবলে তারাও বুদ্ধিজীবী। সেই অর্থে সুশীল।

যে চিকিত্সক তার চিকিত্সাশাস্ত্র নিয়ে চর্চার সময় পান না। চেম্বার আর ক্লিনিকগুলোতে রোগী বাণিজ্য করতে করতে সময় পার হয়ে যায়। নানা নামের ও গোত্রের রাজনৈতিক-পেশাজীবী সংগঠনের নেতা হয়ে তদবির, বদলি বাণিজ্য আর দলীয় রাজনীতির ধ্বজা ধরতে ব্যস্ত থাকতে হয়। তিনিও বুদ্ধিজীবী হয়ে অধুনা সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত হন। আগে জানতাম সাংবাদিক সত্যানুসন্ধানী। নির্মোহভাবে সংবাদ সংগ্রহ করা এর বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লে­ষণ করা সাংবাদিকের কাজ। তাই সাংবাদিকের বুদ্ধিজীবী হওয়ায় বাধা নেই। এখন দেখা যায় এখানেও রাজনৈতিক মত-পথের দ্বন্দ্ব ঢুকে গেছে। সাংবাদিকদের নানা রাজনৈতিক মত-পথের আলোকে সংগঠনের অভাব নেই। তখন শংকা হয় এসব দলীয়বৃত্তে বন্দি সাংবাদিকরা সংবাদ পরিবেশনে কতোটুকু নির্মোহ থাকতে পারবেন! তবুও তো তারা সুশীল সমাজের সম্মানিত সদস্য।

আজকের এই ঘোরতর অমানবিক, নৃশংস রাজনৈতিক সংকটে যখন সুশীল সমাজের ভূমিকা রাখার কথা ওঠে আমি খুব বিপন্ন বোধ করি। প্রতিদিন যতোগুলো সম্ভব পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করি। রাত জেগে মেধাবী চেনা মুখগুলোর বার বার উপস্থিতিতে টকশো দেখি আর শুনি। মাঝে মাঝে নিজেও টকশোর জন্য ডাক পাই। স্নেহভাজন প্রযোজক অথবা উপস্থাপককে মজা করে বলি—আমি সেই সিঁথিকাটা মাথায় তেল দেয়া নিরীহ সুশীল। রাজনীতির পো ধরে বিবেক আর মুক্তচিন্তার ধার না ধেরে ঝগড়া-ঝাটি করতে পারবো না। ওরাও মজা করে বলে—স্যার, আপনি আপনার কথা বলবেন। ঝগড়া করতে হবে না।

একসময় জানলাম এই বুদ্ধিজীবী আর সুশীল সমাজের তৃতীয় ভার্সন আছে। একে বলা হয় ‘নাগরিক সমাজ’। যদি বৃহত্তর অর্থে দেশবাসীকে দেশের নাগরিক বলা হয় তবে সমস্যা নেই। সমস্যা যেটুকু তা হচ্ছে এতে সমাজে আর কোনো বিভাজন থাকে না। তাহলে ফ্যালাসি হলেও যুক্তিবিদ্যা মতে যারা বুদ্ধিজীবী আর সুশীল তারাই নাগরিক। তাই দেশের সকল মানুষই বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল। আর যদি নগরবাসী শিক্ষিত প্রথিতযশা মানুষদের আমরা নাগরিক সমাজের সদস্য বিবেচনা করি তবে নতুন সংকট সৃষ্টি হবে। নগরবাসী নন এমন অনেক জ্ঞানীগুণী মেধাবী মানুষ আছেন তাঁরা কোন সংজ্ঞায় পড়বেন?

এতোসব গোলমেলে বিষয় রয়েছে বলেই বোধহয় এখন আর সুশীল বা নাগরিক সমাজের মানুষ জাতির সংকটে সাধারণ মানুষের কাছে আরাধ্য হয়ে উঠছেন না। টেলিভিশনে টকশো শুনতে গেলে এই অস্বস্তি অনেক বেশি স্পষ্ট হয়। একজন বিএনপিপন্থি শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিক এবং একজন আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিক দুই মেরুতে বসে কথা বলতে থাকেন। ভাবখানা কোনো মুক্তচিন্তার অবকাশ নেই। যার যার দলের নেতা-নেত্রীদের কাছে নিজ নিজ দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করতেই হবে। আজকের জাতীয় সংকটেও তাঁরা নির্মোহ থাকতে পারছেন না। আওয়ামী লীগপন্থিরা ব্যস্ত এই সংকট সৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের কোনো দায় নেই এ কথা প্রচার করতে। যখন প্রশ্ন করা হয় কী অসুবিধা হতো গাজীপুরে বিএনপিকে জনসভা করতে দিলে? কেনইবা ৫ জানুয়ারি ঢাকায় বিএনপিকে জনসভা করতে দেয়া হলো না? তখন দলীয় বৃত্তের সুশীল সমাজের মানুষেরা দলীয় বক্তব্যের ভাঙা রেকর্ড বাজাতে থাকেন। মুক্তবিবেক থেকে কোনো বক্তব্য উচ্চারণ করেন না। আন্দোলনের নামে এবার ভয়ঙ্কর নাশকতায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপিপন্থি সুশীলরা এ প্রশ্নে কি মুক্ত বিবেকের প্রকাশ করতে পারছেন। এদেরও যেন সতর্ক অবস্থান বেফাঁস কোনো বিবেকী কথা বলে ফেলে দলীয় নেত্রীর রোষানলে যাতে না পড়েন। তাই সর্বদা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে থাকেন। বিএনপি-জামায়াত যে আন্দোলনের নামে নাশকতা করছে, অসংখ্য নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, দেশের শিক্ষা শৃঙ্খলা নষ্ট করছে, অর্থনীতির চাকা থামিয়ে দিচ্ছে এসব অতি জরুরি মানবিক প্রশ্নে একটি কথাও উচ্চারণ করছেন না। উপরন্তু বলতে থাকেন কবে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে বাসে গানপাউডার দিয়ে আগুন দেয়া হয়েছিলো। আওয়ামী লীগের যুগে কতোটা হরতাল হয়েছে। কতোজন মানুষ মারা গিয়েছিলো। অর্থাত্ সাধারণ মানুষকে মারায় কারা সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখাতে পেরেছে এসবই হচ্ছে জ্ঞানদীপ্ত মানুষদের বক্তব্য।

শুধু যে ছোটো-খাটো নামের দলীয়বৃত্তে বন্দি সুশীলরাই দলীয় মুখপাত্র হচ্ছেন তেমন নয়। বড়-সড় নামী-দামীরাও যে বিবেক-বন্দি অবস্থায় থাকেন তা দেখলে বিস্মিত এবং শঙ্কিত হতে হয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে এমন একজন বুদ্ধিজীবীর লেখা ছাপা হলো। একজন প্রথিতযশা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ছিলেন তিনি। বিএনপি বুদ্ধিজীবী এই প্রাজ্ঞ সুশীল সমাজের সদস্য বর্তমান সংকটের জন্য নানাভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করলেন। একজন মুক্ত মানুষের বিশ্লে­ষণ হিসেবে এতে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে এই যে পেট্রোল বোমা আর ককটেলে মানুষের জীবন বিপন্ন করছে। বার্ন ইউনিটে অসহায় মানুষের আহাজারি। স্কুল-কলেজে থেমে গেছে শিক্ষা কার্যক্রম। ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর সামনে ঘোর অন্ধকার। এসব নিয়ে একটি কথাও লিখলেন না। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারলেন না। একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্বকে স্থূলভাবে এড়িয়ে গেলেন।

কিছুদিন আগের কথা। একসময়ে ছাত্রলীগের তুখোড় নেতা ছিলেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ নেতা। অধুনা নিজেই একটি দল গঠন করেছেন। তিনি বিএনপি-জামায়াতের নৃশংসতার যতো না সমালোচনা করলেন তারচেয়ে অনেক বেশি সমালোচনা করলেন শেখ হাসিনার। যদি একজন দল নিরপেক্ষ মানুষ এভাবে কথা বলতেন তার একরকম ব্যাখ্যা হতে পারতো কিন্তু এই নেতার মুখে অন্য রকম শোনালো। পাশে বসা এক সহকর্মী বললেন ঘাবড়াবেন না। নিজ দলে ঠিকমতো পদ-পদবী না পেলে অনেকেই এভাবে উল্টে যায়।

এসব দেখে-শুনে মনে হয় এমন অতিশয় সুশীল—সুশীল সমাজের মানুষদের উপর ভরসা করে আজকের গুরুতর জাতীয় সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজা কঠিন। সুশীলের তকমা গায়ে নেই তেমন মানুষেরই প্রয়োজন এখন। কেতাবী সংলাপের কোনো তাত্পর্য আমার কাছে নেই। যেদেশের দু’পক্ষের নেতা-নেত্রীরা দীর্ঘদিন একে অন্যের মুখ দেখেন না, প্রতি মুহূর্তে বিষোদগার করেন। সেখানে স্বপ্নবিলাসীরাই সংলাপ থেকে অর্থবহ ফলাফল আশা করেন। আমাদের চোখে গণমানুষের প্রতিরোধ ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।

লেখক : ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawazju@yahoo.com