‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে’ এ সুরের রেশ ধরেই বলতে চাই বাংলা ভাষার সুরের যে ঝংকার তা অন্য ভাষায় খুঁজে পাওয়া দায়। ভাষা আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত ও নিদর্শন। কালামে পাকের ভাষায় ‘খালাকাল ইনসানা আল্লামাহুল বায়ান। আল্লাহ মানুষ তৈরি করে কথা বলার শক্তি দিয়েছেন’। এ শক্তির নামই ভাষা। পৃথিবীর সব ভাষাই আল্লাহর ভাষা এবং তাঁর নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, ‘ওয়া মিন আয়াতিহি খালকুসসামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি ওয়াখতিলাফু আলসিনাতিকুম’ ‘আর তাঁর নিদর্শন হচ্ছে আসমান জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষার বিভিন্নতা’। প্রত্যেক জাতির ভাষাই তার বিশেষ দান। প্রত্যেক জাতির ভাষার স্বীকৃতিই তিনি দিয়েছেন সে জাতির ভাষায় নবী পাঠিয়ে। কালামে পাকে আছে, ‘অমা আরসালনা মির রাসূলি ইল্লা বি লিসানি কাওমিহি’। আমি প্রত্যেক জাতির কাছে সে জাতির নিজস্ব ভাষাভিত্তিক রাসূল পাঠিয়েছি। রাসূলের শাব্দিক অর্থ দূত বা সংবাদ বাহক। ভাষা ছাড়া সংবাদ হতে পারে না তাই রাসূল এবং ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিজ নিজ নবী-রাসূল চিনলেই ধর্ম সংস্কৃতি ভাষাকে চেনা সহজ হয়ে যাবে। এজন্যই মনে হয় লালন গেয়েছিলেন, ‘নবী না মানে যারা মোয়াহেদ কাফের তারা’। নবীকে মানা ভালোবাসা মহান মালিক আল্লাহর হুকুম, যদি আমাকে ভালোবাসতে চাও আমার নবীকে অনুসরণ কর। আমরা মুসলিম হিসেবে সব নবীর আদর্শই আমাদের আদর্শ। কোরআন প্রমাণ করে ভাষা প্রয়োগ ক্ষেত্রে কারও দুর্বলতা থাকলে তার সাহায্যকারী নিয়ে নেয়া। নবীদের সুন্নত যেমন মুসা (আ.)-এর জিহ্বায় জড়তা থাকায় তিনি বলেন, ‘ওয়া আখি হারুন আর আমার ভাই হারুন, হুয়া আফসাহু মিন্নি লিসানান’। তিনি আমার চেয়ে প্রাঞ্জলভাষী, ফা আরসিলহু মায়ি রুদান। তাকে আমার সহযোগী করে দিন। কালামে পাকের এ আয়াত থেকে বুঝা যায় নবী-রাসূলদের কথা মানুষের বোধগম্য হওয়া জরুরি। কিন্তু আমরা যে তোতা পাখির মতো কোরআন-হাদিসের বুলি আওড়িয়ে যাচ্ছি বোঝার চিন্তা করছি না নানা যুক্তি দেখিয়ে জুমার খুতবা আজও মুসল্লিদের বোধগম্য সমসাময়িক ভাষায় দেয়া হচ্ছে না। আমাদের ইমামদের জীবন পাঠ করলে দেখি ক্ষমতা তাদের হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, কিন্তু তারা দ্বীনি গবেষণায় বিচ্যুতি ঘটবে এজন্য ক্ষমতা থেকে দূরে থেকেছেন। যাদের বুঝানোর দায়িত্ব তারাও সে দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মতো ধর্মকে তারা নিজেদের আয়ত্তে রেখে বলেছে ধর্মীয় বিষয়ের চর্চা ধর্মীয় ভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় বৈধ নয়। অথচ এ দেশে যেসব সুফি দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে এসেছেন তারা এ দেশের ভাষাকেই নিজের ভাষা করে নিয়েছেন।
জনতার সঙ্গে জনতার ভাষায় এলিটদের সঙ্গে এলিটদের ভাষায় কথা বলেছেন। দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কথা কে না জানেন। তিনি ক্ষমতা এবং ক্ষমতাওয়ালার কাছ থেকে দূরে থাকতেন ফলে জনগণ তাকে আপন মনে করে তার খানকায় ভিড় করত। এজন্য হিংসা হতো সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের। রাজ দরবারে ডাকলেও তিনি বলতেন রাজা-বাদশার কাছে আমার কোনো কাজ নেই, ফকিরের আস্তানাই আমার বালাখানা। তুঘলক খাজা নিজামকে তার প্রতিপক্ষ মনে করলেও জনতা বিগড়ে যাবে এ ভয়ে কিছু বলেননি। তুঘলক কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের ফলে তিনি মনে করলেন জনমত তো বিজয়ীর পক্ষেই থাকে তাই দূত মারফত চিঠি পাঠালেন। আমি দিল্লি আসার আগেই আপনি দিল্লি ছেড়ে চলে যাবেন, নতুবা আমি এসে আপনার আস্তানা গুঁড়িয়ে দেব। চিঠি পেয়ে খাজা নিজাম জবাবী পত্রে লিখলেন, ‘দিল্লি হনুজ দুরাস্ত’ (দিল্লি তো বহু দূর) এ কথার হাকিকত বাদশাহ না বুঝে পারিষদবর্গকে তার বিজয়ের সংবর্ধনার আয়োজন করতে বলে বাইরে অবস্থান করতে থাকেন। এর মধ্যে প্রবল ঝড়ে তার অস্থায়ী প্রাসাদ ভেঙে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু খাজা নিজামুদ্দিন এখনও দিল্লিতে শুয়ে থেকে দিল্লিবাসীকে রূহানি শাসন করে যাচ্ছেন।