Tuesday, 31 March 2015

নারী-পুরুষে রচিত মানব সভ্যতা

দয়াময়ের করুণাতেই তো বেঁচে আছি আমরা। তার করুণা ছাড়া কোনো সৃষ্টির অস্তিত্বের কল্পনা সম্ভব নয়। জগতের চিরস্থায়ী সুখ অথবা দুঃখ নির্ধাণের পরীক্ষার জন্যই আমাদের পাঠানো হয়েছে এ দুনিয়ায়। কোরআনে এরশাদ হচ্ছে ‘যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমাদের পরীক্ষা করেন যে, তোমাদের মধ্যে কাজে কে অধিক উত্তম’। দুনিয়ার সামান্য এ ক্ষণটি আমাদের পরীক্ষার সময়, মূল গন্তব্য আখিরাতের পথে। তাই পরীক্ষার হলে যেমন নির্দিষ্ট কিছু নিয়মে চলতে হয়। দুনিয়ার সময়টি যথার্থ ও আনন্দময় করার জন্য মানবজাতিকে সৃষ্টিগতভাবে নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, নারী ও পুরুষ মিলেই পূর্ণ হয়েছে মানবসভ্যতা। আর নারী ও পুরুষের মাঝে সামান্য কিছু পার্থক্য মূলত কোনো বিভাজন নয়, বরং সৃষ্টির পূর্ণতা ও উৎকর্ষতার জন্যই একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সৃজিত জুটি সৃষ্টার অপরূপ ও মমতাময়ী সৃষ্টি নারীজাতি। পবিত্র কোরআনে নারীদের ব্যাপারে আল্লাহর বাণী- হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। তেমনি আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচনা করে থাক এবং আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।’ এটি সূরা নিসার প্রথম আয়াত।

[‘নিসা’ শব্দটির অর্থ নারী।] এ সূরা নিসা নামটিই প্রমাণ করে কোরআন নারী জাতিকে, কি সম্মান দিয়েছে। মূলত এ আয়াতটি নারী জাতি সম্পর্কে ইসলামের ভাবধারা, ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও সম্পর্কের রূপরেখা সম্পর্কে পূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। প্রথমত আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে কারিমায় ইরশাদ করেন, এ দুই শ্রেণীর সৃষ্টি একই পদ্ধতিতে হয়েছে। এ দুই শ্রেণীর ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। যেন একই দেহের দুটি অঙ্গ। পুরুষ ও নারীর শারীরিক গঠনাকৃতিতে সামান্য পার্থক্যের কারণ হচ্ছে, যাতে দু’জন তাদের জীবন সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে পাড়ি দিতে পারে। কেননা প্রথমত এ দুই জাতির অস্তিত্ব একই সত্তা থেকে। তারপর ওই এক সত্তাকে দু’ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এতদসত্ত্বেও এ দু’জাতির মধ্যে কোনো বিরোধ-বৈপরিত্য নেই। বরং অবশেষে তারা গিয়ে একই কেন্দ্রে মিলিত হয়।

এ পৃথিবীতে সফররত মানুষকে তার সফরসঙ্গী স্বজাতি থেকে দেয়া হয়েছে আর সে তারই শরীরের অংশ। এরপর ওই দু’জনের মাধ্যমে মানব প্রজন্মের সৃষ্টি ও বিস্তার হয়েছে। আল্লাহতায়ালা দু’জনের বন্ধুত্ব, প্রেম-ভালোবাসা ও সহযাত্রায় বরকত দান করেছেন। ফলে যারা মাত্র দু’জন ছিল, তাদের থেকে জন্ম নিয়েছে শত-সহস্র আর হাজার থেকে লাখলাখ কোটি। এমনকি মানব জাতির নির্ভুল পরিসংখ্যান কেউই দিতে পারবে না, কত কত মানুষ সৃষ্টি হয়েছে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। ‘কাসিরা’ শব্দে সে ইঙ্গিতই করেছেন আল্লাহ।

এত গেল সৃষ্টির সূচনা ও নারীর সৃষ্টিগত মর্যাদার বিষয়। এখন আমরা দেখব সামাজিকভাবে ইসলাম নারীর কতটুকু মূল্যায়ন করেছে এবং সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করেছে, সূরা আহযাবের ৩৫নং আয়াতের অর্থ ‘নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ, ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীলা নারী, রোজা পালনকারী পুরুষ, রোজা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী নারী, আল্লাহর অধিক জিকিরকারী পুরুষ ও জিকিরকারী নারী- তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’ দেখুন, আল্লাহর বাণী কত প্রজ্ঞাময়, পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এ আমলগুলোর চেয়ে উত্তম প্রতিষেধক আর কি হতে পারে। কাজেই মহান আল্লাহ ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের ঐক্যবদ্ধ আর কল্যাণ তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্যকারী রূপে দেখতে চান। তিনি ইরশাদ করেন ‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহর দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, সুকৌশলী’। (সূরা ওতওবা : ৭১)।

ইসলামে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা স্পষ্ট, প্রথমত নারীকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। তাই শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে নারীর পিছিয়ে থাকার কোনো অবকাশ নেই। আজকের এ সময়ে আমাদের নারীরা সমাজে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। মানুষ হিসেবে এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। বিশ্বজুড়েই নারীরা আজ নিগৃহিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে। তাই সৃষ্টির উৎস মমতাময়ী নারী জাতির সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নতির জন্য আল্লাহর বিধানই হতে পারে একমাত্র মুক্তির সনদ।

© তানজিল আমির
www.facebook.com tanjil amirl

বর্ণবাদের আগুন এবং মানবতার সাম্যবাদ

মানুষের বড় পরিচয় সে মানুষ। পৃথিবীর সব মানুষ মিলে যে বিরাট এক মানবপরিবার প্রতিটি মানুষ সেই গর্বদীপ্ত সংসারের সদস্য। সম্মান ও গৌরবের এই অম্লান মুকুট প্রতিটি মানুষের জন্মগত অর্জন। এই মুকুট ছিনিয়ে নেওয়ার অধিকার নেই কারও। সাদা-কালো, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু আরব আজমÑ এসবই ক্ষুদ্রতার হিংস্র নখর। এই নখর যখনই যেখানেই উদ্যত হয় রক্তাক্ত হয় মানবতা; বিক্ষত হয় মানবসভ্যতার বিমল বদন। মানব ও মানবতার চিরন্তন শত্রু এই বিভেদ দানব। ভেদাভেদের এই দানব যেখানেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সেখানেই ধূলিসাৎ হয়েছে মানব জীবনের সমূহ শৃঙ্খলা। ভেঙে গেছে মানবতার সব আয়োজন। মানুষ নেমে গেছে পশুর স্তরে।
মানবজাতির অতীত ইতিহাসজুড়ে যেমন ছড়িয়ে আছে ভেদাভেদতাড়িত এমন অনেক কলঙ্কের ইতিহাস, তেমনি আছে মানুষের মাথা উঁচু করা অনেক উজ্জ্বল অর্জন। বলতে দ্বিধা নেই, মানুষ হিসেবে যতটুকু মানমর্যাদা এবং সম্মানের আশিস আমরা আমাদের দয়াময় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে লাভ করেছি সেটাই আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। শাশ্বত ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ এক নারী থেকে। তারপর তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রেÑ যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহভীরু। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব খবর রাখেন।’ [হুজুরাত : ১৩]

অর্থাৎ সমুদয় মানুষ একজন পুরুষ ও একজন নারীর সন্তান। একই নারী-পুরুষের সন্তানদের মধ্যে যেমন মান ও রঙের কোনো ভেদাভেদ থাকতে পারে না তেমনি পৃথিবীর কোনো মানুষের সঙ্গে অপর কোনো মানুষের বর্ণ, বংশ ও মানের ভেদাভেদ থাকতে পারে না। উচু-নিচুর কোনো প্রশ্নই দাঁড়াতে পারে না এখানে। এ শুধু বংশানুক্রমিক মানব ইতিহাসেরই দাবি নয়। যে মিথ্যা অহংবোধ জন্ম দেয় বিভেদের পঙ্ক এবং বিভাজনের কলঙ্ক কত শক্ত ভাষায় তার মূলোৎপাটন করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তা। জগতের প্রতিটি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেনÑ ‘কালপ্রবাহে প্রতিটি মানুষের ওপর তো এমন একটি সময় এসেছিল যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শক্রবিন্দু থেকেÑ তাকে পরীক্ষা করার জন্য; আর এ জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছিÑ হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি শৃঙ্খল বেড়ি ও লেলিহান অগ্নিশিখা। [দাহর-৭৬:১-৪]

এটা পবিত্র কোরআনের ৭৬ নম্বর সুরা। এই সুরাটির দুটি নামÑ দাহর ও ইনসান। দাহর অর্থ কাল ও সময় আর ইসসান অর্থ মানুষ। মর্ম খুবই সরল। সামান্য পানি থেকে সৃষ্টিজগতের প্রতিটি মানুষের। ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, সাদা-কালো কোথাও এই নিয়মের ব্যত্যয় নেই। তাহলে কেন মানসম্মানে ব্যত্যয়ের হিংস্র প্রকাশ! কালপ্রবাহে প্রতিষ্ঠিত সর্বজনবিদিত মানবজীবনের এই মমতার সৃষ্টিগত রেখায় যারা সমর্পিত তারাই ‘মানুষ’। যারা সৃষ্টি ও জন্মের সুবাদে প্রাপ্ত এই শিক্ষাকে ভুলে যায়, ভুলে যায় একজন পুরুষ ও একজন নারীর বন্ধনে প্রতিষ্ঠিত বনুআদমিক সাম্যের আত্মীয়তা তারা মানুষ নয়Ñ মানুষ সমাজের কলঙ্ক! নজরুল ভালোই বলেছেন
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি!
[সঞ্চিতা : কবিতার নাম : মানুষ]

আমাদের নবীর কথা বলি! প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন : আমি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম তিনি কাবা শরিফ তাওয়াফ করছেন এবং বলছেন : এত যে শ্রেষ্ঠ তুমি আর কত যে শ্রেষ্ঠ তোমার সুবাস! কত যে মহান তুমি আর কত যে মহান তোমার সম্মান! সেই আল্লাহর শপথ যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণÑ একজন মুমিন বান্দার সম্মান আল্লাহর কাছে তোমার সম্মানের চেয়েও অধিক! তার জীবন ও সম্পদ সম্পর্কে অশুভ কিছু ভাবা যায় না।’ [আলমাকাসিদুল হাসানা, হাদিস : ১২২০]

 আমরা স্মরণ করতে পারি বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণের কথাও। লক্ষাধিক সাহাবির বিশাল সমাবেশে তিনি খাপখোলা তরবারির ভাষায় বলেছেনÑ হে লোক সকল! মনে রেখো! তোমাদের সকলের প্রভু একজন এবং তোমাদের পিতাও একজন। কোনো আরবি কোনো আজমির চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। নয় কোনো আজমি কোনো আজমি কোনো আরবির চাইতে শ্রেষ্ঠতর কোনো সাদা কোনো কালোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়; নয় কোনো কালো কোনো সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ! তবে তাকওয়া ও আল্লাহভীরুতার বিাচরে... [মানবতার নবী : ৩৪]

কোনো সাদা কোনো কালোর চাইতে শ্রেষ্ঠ নয় এমন বাণী হয়তো আরও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে! হয়তো পাওয়া যাবে কালো মানুষের পক্ষে বয়িত দীঘল দীঘল কবিতা এবং দার্শনিক অনেক রচনাও। কিন্তু সত্যিকার অর্থে সাদা-কালোর ভেদাভেদ ভেঙে সমাজজীবনে কালোকে সাদার সঙ্গে সমান গৌরবে সমান সম্মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি নির্মাণে ইসলাম ও ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অবদান রেখেছেন তা সভ্যতার ইতিহাসে এক অবাককরা বাতিঘর! ধর্মদর্শন আর যাপিত জীবনের এমন মিল হয়তো আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি যেখানেই মুসলমানের বাস সেখানেই বাজিয়ে দেখা যেতে পারে, আমাদের এই দাবি কতটা সত্য। এখনো প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ কাবার প্রাঙ্গণে সমবেত হয় ওমরা করতে। ছুটে যায় পাক মদিনায় নবীজির কবর জিয়ারত করতে। সাদা-কালো আর আরব আজম কী যে আন্তরিকতায় মিশে যায় পথের বাঁকে বাঁকে! গভীর উষ্ণতায় করমর্দন করছে! পরস্পরে আলিঙ্গনে মিলিত হচ্ছে। হয়তো জীবনে এই প্রশ্ন সাক্ষাৎ। কিন্তু উদ্ভাসিত হাসি যে কথা অনুমান করতেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরচেয়ে বড় কথাÑ মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ ইবাদত নামাজে পৃথিবীজুড়ে কত যে কালো সাদাদের ইমাম হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে তার কোনো হিসাব কষা যাবে?

এই বেলাল রা.-এর কথাই বলি! পৃথিবী একশ সত্তর কোটি মুসলমান যতটা সম্মান ও গৗরবের সঙ্গে স্মরণ করে হজরত আবু বকর সিদ্দিক, হজরত ওমর ফারুক, হজরত উসমান ও হজরত আলী রা.কে ঠিক ততটা আবেগ ও সম্মানেই স্মরণ করে হজরত বেলাল রা.কে। অথচ তিনি ছিলেন একজন হাবশি কৃষ্ণবর্ণ ক্রীতদাস! সমকালীন অর্ধেক পৃথিবীর শাসক হজরত ওমর রা. যখনই হজরত আবু বকর রা.-কে স্মরণ করতেন, স্মরণ করতেন হজরত বেলাল রা.-কেও। বলতেনÑ ‘আবু বকর আমাদের নেতা আর তিনি আজাদ করেছেন আমাদের নেতা বেলালকে।’ অথচ কেউ যখন নানা কৃতকর্মের কথা বলে মুখের ওপর প্রশংসা করত হজরত বেলাল বিনয়ের সঙ্গে মাথানত করে উত্তর দিতেনÑ ‘আমি তো একজন কৃষ্ণবর্ণ হাবশি... গতকালও এক ব্যক্তির ক্রীতদাস ছিলাম!

আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম ঘটনা মক্কা বিজয়। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আর সম্মানিত সঙ্গীগণকে শুধু এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সমর্পণের ‘অপরাধে’ আপন জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। মাত্র আট বছরের ব্যবধানে যখন ফিরে আসেন প্রিয় মক্কায় মহান বিজয়ীর বেশে তখন পুরো মক্কাকে আন্দোলিত করে কাবা শরিফের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আজান দিয়েছিলেন হজরত বেলাল রা.! অতঃপর বিজিত মক্কাবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে আমাদের নবীজি বলেছিলেনÑ ‘হে কুরায়েশ সম্প্রদায়! আল্লাহতাআলা তোমাদের মূর্খতার যুগের অহঙ্কারকে চূর্ণ করে দিয়েছেন; চূর্ণ করে দিয়েছেন বাপ-দাদাদের নামের দাম্ভিকতাকে! শোন, সকল মানুষ এক আদমের সন্তান আর আদম ছিলেন মাটির তৈরি। [রিজালুন হাওলার রাসুল : ১০৪]

রঙ নয়Ñ গুণ ও চরিত্রের মাপে মানুষকে গ্রহণ করার এই যে শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন আজও শিক্ষার সেই সরল রেখা থেকে একপা বিচ্যুত হয়নি মুসলিম উম্মাহ। শুভ্র ও ক্রীমবর্ণ পোশাকে চিকচিকে কালো কিশোরদের প্রাণময় উপস্থিতি যারা অন্তত একবার মক্কা শরিফ কিংবা মদিনা শরিফে দেখেছেনÑ শীতল করা কাজলবরণ সেই ছবি সেকি জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবে? এক কথায় বর্ণবৈষম্যের কলঙ্ক বিনাশে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অবদান রেখে গেছেন মানব ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই।

বিশেষ করে তাকে মনে পড়ে তখন যখন এই একুশ শতকের বিদ্বান পৃথিবীতে বসে পড়তে হয় পত্রিকার শিরোনামÑ ‘কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে শ্বাসরোধে হত্যা’ খালাস আরেক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ।’ ঘটনা আমাদের মতো কোনো গরিব কিংবা শিক্ষাবঞ্চিত কোনো আফ্রিকান দেশের নয়। সরাসরি শিক্ষা ও সভ্যতার পীঠস্থান আমেরিকার। পত্রিকার ভাষায়Ñ যুক্তরাষ্ট্রে এবার আরও এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি হত্যার দায়ে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন নিউইয়র্কের স্ট্যাটেন আইসল্যান্ড আদালতের একটি গ্যান্ড জুরি। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় অনুযায়ী বুধবার (৩.১২.১৪) গ্র্যান্ড জুরি (মামলা চালানোর জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়নকারী বিচারকদের বোর্ড) এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই দেশটির বেশ কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে অবশেষে মার্টিন অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার জানান, কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয়ভাবে তদন্তের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এই হলো আমাদের উদার আমেরিকা! এখানে আমরা এও স্মরণ করছিÑ ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের আদেশÑ ‘সকল আফ্রিকানকে তাদের সঙ্গে পরিচিত বই রাখতে হবেÑ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে ২১ মার্চ সে দেশের শার্পভিলে সমবেত বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ৬৯ ব্যক্তি নিহত ও ১৮০ জন আহত হয়। অবশেষে ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৬০ সালের শার্পভিল ঘটনার স্মরণে ২১ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিকে বর্ণবৈষম্য বিলোপের আন্দোলন দ্বিগুণ তীব্র করার জন্য বিশ্ব সমাজকে অনুরোধ জানায়। সেই থেকে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত সব দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশেও। আমরা বিশ্বাস করিÑ এই দাবি মহৎ ও মানবিক। প্রশংসিত এই আয়োজন। তবে বর্ণবৈষম্যের আগুন থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হতে হলে সমর্পিত হতে হবে পরীক্ষিত শরণালয়ে। পৃথিবীর দেড় হাজার বছরের যাপিত ইতিহাস এবং যুগযুগান্তের ধর্মদর্শনের ইতিহাস সাক্ষীÑ পৃথিবীর সব মানুষকে মর্যাদার একই চাদোয়ার নিচে যেভাবে সমবেত করতে পেরেছেন ইসলামের নবী তেমনটি আর কেউ পারেনি। তিনিই পেরেছেন স্পষ্ট করে বলতেÑ যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়। [আবু দাউদ, হাদিস : ৫১২৩] সুতরাং দল গোষ্ঠী ও বর্ণবাদের কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে বর্ণবাদের আগুন থেকে ফিরে যেতে হবে পাক মদিনায় হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে।

লেখক : মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, শিক্ষাবিদ ও কলামনিস্ট

Tuesday, 24 March 2015

ইসলাম অর্থ আল্লাহতে আত্মসমর্পিত হওয়া


ইসলাম অর্থ আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করা এবং সম্পূর্ণভাবে সেই মহান সত্তার অনুগত থাকা। ইসলাম হলো আল্লাহর প্রেরিত দীন। এই দীন বা জীবন ব্যবস্থায় নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে সমর্পিত করতে হয়। আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়।

পবিত্র কোরআনের সূরা আলে-ইমরানের ৮৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করা হয়েছে 'কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো জীবন ব্যবস্থা তালাশ করলে আদৌ তার থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। আর সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।'

উক্ত আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। যারা অন্য কোনো জীবন ব্যবস্থায় প্রলুব্ধ হবে পরকালে তাদের কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।

পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত, আল্লাহর একাত্ববাদ অর্থাৎ আল্লাহ এক এবং তাঁর কোনো শরিক নেই, এটিকে মনে-প্রাণে বিশ্বাসের পাশাপাশি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল হিসেবে স্বীকার করা। দ্বিতীয়ত, নামাজ আদায় করা, তৃতীয়ত জাকাত প্রদান করা, চতুর্থত, রোজা পালন করা এবং পঞ্চমত, পবিত্র কাবাঘরে হজ করা।

আল্লাহর কাছে নিজের সত্তাকে সমর্পণ করা ও সেই মহান সত্তার অনুগত থাকার জন্য এই পাঁচটি স্তম্ভের প্রতি মুমিনদের মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে। আল্লাহর হুকুম-আহকাম পালনে আন্তরিক হতে হবে। তবে নিছক আল্লাহর হুকুম-আহকাম পালনই ইসলাম নয়। ইসলাম হলো আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণভাবে আনুগত্য পোষণ করা। আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সন্দেহাতীতভাবে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানো। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান এবং অন্যান্য সব মানুষ হতে প্রিয়তম হই। (বোখারি)

নিজেকে আল্লাহর দীন ইসলামের অনুসারী বলে দাবি করতে হলে সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হতে হবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যার জবান ও হাত হতে মুসলমানরা নিরাপদ রয়েছেন তিনিই সত্যিকারের মুমিন।

লেখক : মাওলানা আবদুর রশিদ, গবেষক।

ইসলাম নামের অর্থ, তাৎপর্য ও গুরুত্ব


ইসলাম আরবি শব্দ। উৎপত্তিগত দিক থেকে মূল রূপটির অর্থ হলো যে কোনো ত্রুটি কিংবা ক্ষতিকর জিনিস থেকে মুক্ত থাকা। ইসলাম হচ্ছে মূল শব্দটির ক্রিয়া রূপ। এর অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশে প্রবেশ করা, যাকে আমরা আত্মসমর্পণ বলে বুঝিয়ে থাকি। এই ক্রিয়ার সক্রিয় বিশেষণ রূপ হলো মুসলিম, যা আত্মসমর্পণকারী বুঝিয়ে থাকে। একটি শব্দের মূলের দিকে তাকানো যে কত বেশি গুরুত্ব বহন করে, তা অনেকের কাছে হয়তো স্পষ্ট নয়। তবে আরবি ভাষায় এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনে হতে পারে ইসলাম মানে শান্তি। মুসলমানরা প্রায় সময়ই ইসলামের অর্থ এটাই করে থাকেন।

কোরান কারিমে ইসলাম ধর্মকে বোঝাতে ভিন্ন কয়েকটি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এর একটি হলো ‘শান্তি’। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, হে ইমানদাররা! তোমরা আল্লাহর দিকে শান্তির মধ্যে প্রবেশ কর পুরোপুরি। এখানে ‘আল সিল্্ম’ কথা দিয়ে ইসলামকে বোঝানো হয়েছে আর এটা যুদ্ধের বিপরীত। তাফসিরকারকদের অভিমত এটাই। অর্থাৎ ইসলামকে যেমন আত্মসমর্পণ বলা হয়, তেমনি বলা হয় শান্তি। এমন বহু নামে ইসলাম অভিহিত হয়ে থাকে। ইসলাম কেবল শান্তির ধর্ম নয়, ইসলাম জীবনেরও ধর্ম। এর মানে হলো এই সংকটপূর্ণ বিশ্বে আমাদের জীবনে যত ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে, সব ক্ষেত্রেই ইসলাম দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম। কোরানে বহুবার ‘ইসলাম’ কথাটা এসেছে। সুতরাং ইসলাম নামটি একটি ঐতিহাসিক নাম। আল্লাহ তায়ালা কোরানে কারিমে ঘোষণা করেছেন, তার সমুদয় সৃষ্টিই তার কাছে আত্মসমর্পিত এবং একমাত্র প্রকৃত উপাস্যরূপে তার কাছেই মানবজাতি আত্মসমর্পণ করা উচিত। সর্বোত্তম ধর্ম হলো কারো মাথাকে আল্লাহর কাছে নত করা এবং ভালো কাজ করা।

একই পরিভাষা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে নবী-রাসুলদের (আ.) কাহিনীতে। কোরানে উল্লিখিত ওইসব দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যায়, আত্মসমর্পণের ধর্ম (ইসলাম) প্রকৃতির মাঝে যেমন প্রোথিত, তেমনি ইতিহাসে এর মূল নিহিত। যেমন কোরানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর দৃষ্টিতে ধর্ম হলো ইসলাম’। ‘আজকের এ দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে করে দিলাম পরিপূর্ণ এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহগুলো সম্পূর্ণ করে দিলাম আর তোমাদের জীবনবিধান হিসেবে ইসলামকে নির্ধারণ করে দিয়েছি।’ ‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে ডাকে আল্লাহর দিকে, সৎ কাজ করে এবং বলে, আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’

লেখক: মুফতি এনায়েতুল্লাহ, শিক্ষক ও কলামিস্ট
সর্বজনীন শুভেচ্ছা সালাম 
মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা হলে শুভেচ্ছা জানানোর বিষয়টি বহুকাল থেকে চলে আসছে। এটা মানব সভ্যতার একটি গৌরবজনক অনুষঙ্গ। ধর্ম, জাতি ভেদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষাও হয়েছে হরেক ধরনের। বোখারিতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পর বললেন, যাও, তুমি ওই বসে থাকা ফেরেশতাদের সালাম করো। তারপর ভালো মতো শুনবে তারা কীভাবে সালামের উত্তর দেয়। আর এটাই হবে তোমার সন্তানদের পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা। এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট হলো, সালাম হলো সব মানুষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা, যা তাদের পিতাকে প্রথমেই শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তার অধিকাংশ সন্তান ভুলে গেছে সেই শুভেচ্ছা বিনিময়। কিন্তু ভুলেনি তার মুসলিম সন্তানরা।

আল কোরআন থেকে আরও জানা যায়, যখন ইবরাহিম (আ.) এর কাছে ফেরেশতারা এলো তখন তারা সালাম দিল। এমনিভাবে ইবরাহিম (আ.) তার মুশরিক পিতাকে সালাম দিয়েছেন। নবী ইবরাহিম (আ.) কে মুসলিমরা তাদের জাতির জনক বলে বিশ্বাস করে। আল কোরআনে আল্লাহ তা উল্লেখও করেছেন। আবার ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের মানুষ ইবরাহিমকে তাদের ধর্মের আদি পিতা বলে জানে। এমনকি ইহুদিরা বলে, ইবরাহিম ইহুদি ছিলেন, আর খ্রিস্টানরা দাবি করে, ইবরাহিম ছিলেন খ্রিস্টান। আল কোরআন এ প্রসঙ্গে বলেছে, ইবরাহিম ইহুদি ছিলেন না, সে খ্রিস্টানও ছিলেন না। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। ইবরাহিমের ইহুদি বা খ্রিস্টান হওয়ার প্রশ্ন আসে কী করে? এ নামকরণ তো তার চলে যাওয়ার অনেক পরে হয়েছে। যাক, নবী ইবরাহিম (আ.) যখন সালাম চর্চা করেছেন, তখন তা এ তিনটি ধর্মেরই বিষয় হতে পারত। তবে ইসলাম শুভেচ্ছা বিনিময়ের ব্যাপারটাকে এত গুরুত্ব দিয়েছে, অন্য কোনো ধর্ম বা মতাদর্শ সে গুরুত্ব দেয়নি।

আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে সালাম দিতে বলেছেন। সালামের উত্তর দেয়াকে অপরিহার্য কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) যখন মদিনায় এলেন তখন প্রথম যে কথাগুলো সবাইকে বললেন তা ছিল : 'সালামের প্রসার ঘটাও! মানুষকে খাদ্য দান করো! যখন রাতে মানুষ ঘুমে থাকে তখন সালাত আদায় করো... ।'

সেখানে সালামের প্রচলন এত ছিল, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা রাসূলকে সালাম দিত। রাসূল তাদের সালামের উত্তর দিতেন। মূলের দিক দিয়ে 'ইসলাম' ও 'সালাম' শব্দ দুটি একই। সালাম অর্থ শান্তি। আর ইসলাম অর্থ আল্লাহর সামনে আনুগত্য প্রকাশার্থে আত্মসমর্পণ করা। অন্য অর্থে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।

শেষোক্ত অর্থ অনুযায়ী মুসলিম শব্দের অর্থ হলো শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী। একটা শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্র ভেদে অর্থ ভিন্ন হতে পারে। একজন পুরুষ ব্যক্তি যখন বলে আমার বউ, তখন আমরা বুঝে নেই এখানে 'বউ' মানে স্ত্রী। কিন্তু একজন বয়স্ক নারী যখন বলে আমার বউ, তখন আমরা বুঝি এখানে 'বউ' মানে পুত্রবধূ।

ইসলাম শব্দটা যখন মানুষ ও স্রষ্টার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় তখন এর অর্থ হয়, পরম আনুগত্যে স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করা। আর ইসলাম শব্দটা যখন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ হয় শান্তি দান করা বা শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ঠিক সে হিসেবে 'সালাম' শব্দের ধাতুগত অর্থ শান্তি। আর তার থেকে আসা 'ইসলাম' শব্দের অর্থ শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। যেমন রাশাদ শব্দের অর্থ সঠিক পথ লাভ করা। আর এরশাদ শব্দের অর্থ সঠিক পথ প্রদর্শন করা। আর মুরশিদ শব্দের অর্থ হলো, সঠিক পথ প্রদর্শনকারী। সে অনুসারে মুসলিম শব্দের অর্থ যথাক্রমে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী ও মানুষের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী। আর এ জন্যই শান্তির বাহক একজন মুসলিম কোনো মানুষকে দেখলেই বলবে আসসালামু আলাইকুম_ আপনার প্রতি শান্তি।

মুসলিমরা শুভেচ্ছা বিনিময়ে এমন ভাষা প্রয়োগ করে যা বিশ্বের সব মানুষ পছন্দ করবে। এ ভাষায় কোনো ব্যক্তি, ধর্ম, সময়, রাষ্ট্র বা সম্প্রদায়ের কোনো বিজ্ঞাপন নেই। আবার তা সকাল, দুপুর বা সন্ধ্যার মধ্যেও বন্দি নয়। সারাক্ষণই সালাম আর সালাম_ শান্তি।

© আবদুুল্লাহ শহীদ আঃ রহমান

মহানবীর আদর্শই শান্তির পথ

উম্মতের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছানোর মাধ্যম হলেন নবী-রাসূলরা। সে ধারাবাহিকতায় আখেরি উম্মতের কাছে আল্লাহর সব দিকনির্দেশনা ও বিধিনিষেধ পৌঁছেছে আখেরি নবীর মাধ্যমে। এই মাধ্যম ব্যবহার না করে সরাসরি উম্মতের কাছে আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হলে তাদের পক্ষে সেগুলো শোনা ও বোঝা সম্ভব ছিল না। হজরত মুসা (আ.) মানসিক ও শারীরিকভাবে এত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর তাজালি্লতে তুর পাহাড়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ ময়দানে হাশরে আল্লাহপাক মানুষকে এমন শক্তি দান করবেন যে, মানুষ সেদিন আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং কথাবার্তা বলতে সক্ষম হবে।

আখেরি নবী (সা.) এর সময় থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তি এবং সফলতার পথ দেখানোর জন্য আল্লাহ সাইয়্যেদুল আম্বি্বয়া হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে পাঠিয়েছেন। অতএব মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধসহ সব জাতির শান্তি ও সফলতার জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একমাত্র পথ হলো রাসূলে করিম (সা.) এর পূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ। যারা নবীর আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করবে না তারা কোনো দিন প্রকৃত শান্তি ও সফলতার পথ খুঁজে পাবে না। নবী (সা.) বলেছেন, 'যদি মুসা (আ.) জীবিত থাকতেন তাহলে আমার অনুসরণ করতে বাধ্য থাকতেন।' অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিস্টান তো দূরের কথা যদি তাদের নবীরাও জীবিত থাকতেন তাহলে রাসূল (সা.) এর অনুসরণ-অনুকরণ করা ছাড়া তাদের নাজাতের উপায় থাকত না।

মুসলমানদের আকিদা হলো হজরত ঈসা (আ.) কে জীবিত অবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। কেয়ামতের আগে পুনরায় তিনি দুনিয়াতে আসবেন। ইহুদিদের আকিদা হলো হজরত ঈসা (আ.) কে হত্যা করা হয়েছে। খ্রিস্টানদের অনেকের ধারণাও তাই। যারা বলে হজরত ঈসা (আ.) কে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের ধারণা একদম ভিত্তিহীন। মুসলমানরা যদি এমন আকিদা রাখে তাহলে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, 'তারা তাকে (ঈসা আ.) হত্যা করতে পারেনি, ক্রুশবিদ্ধও করতে পারেনি, বরং তাদের ধাঁধায় ফেলা হয়েছিল। এ বিষয়ে যারা মতানৈক্য করে তারা তো নির্ঘাত সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে। এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ করা ব্যতীত তাদের কোনো জ্ঞানই নেই। একথা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করতে পারেনি; বরং আল্লাহ তাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন।'

ইহুদিরা যখন হজরত ঈসা (আ.) কে হত্যা করতে ঘরে প্রবেশ করল তখন আল্লাহ নিজ কুদরতে তাকে আকাশে উঠিয়ে নিলেন। আর যে ব্যক্তি হত্যা করার ইচ্ছায় প্রথমে ঘরে প্রবেশ করেছিল আল্লাহপাক তার চেহারাকে হজরত ঈসা (আ.) এর চেহারায় রূপান্তরিত করে দিলেন। তখন অন্যরা তাকেই হজরত ঈসা মনে করে হত্যা করল। হত্যাকারীদের তখন এটা বোঝানো অসম্ভব ছিল যে, সে আসল ঈসা নয়, নকল ঈসা। আল্লাহপাকের দয়া যে, তিনি কোরআনের মাধ্যমে এর সত্যতা আমাদের জানিয়েছেন। চোখের দৃষ্টির চেয়ে আমাদের কোরআনের ওপর বিশ্বাস বেশি। ইহুদি-খ্রিস্টানদের বিশ্বাস কোরআনের ওপর নেই বলে এখনও তারা অন্ধ বিশ্বাসে নিমজ্জিত হয়ে আছে। ইহুদিদের দাবি হলো, তারা হজরত ঈসা (আ.) কে হত্যা করেছে, শূলবিদ্ধ করেছে। তাদের ধারণায় হত্যার কারণ হলো, তিনি জারজ ছিলেন (নাউজুবিল্লাহ)। কারণ তিনি পিতা ছাড়া দুনিয়াতে এসেছিলেন। ইহুদিদের কথাকে খ্রিস্টানরাও প্রকারান্তে মেনে নিয়েছে।

আমরা বিশ্বাস করি, হজরত ঈসা (আ.) কেয়ামতের আগে আবার দুনিয়ায় আসবেন সাবেক ও প্রাক্তন নবী হিসেবে। আমাদের দেশে বর্তমান সরকারের সময় যেমন সাবেক সরকার ও মন্ত্রীদের কোনো কথা চলে না, তেমনি হজরত ঈসা (আ.) এর কথাও তখন চলবে না। বরং তিনি শেষ নবীর শরিয়ত ও আদর্শ অনুসরণ করে চলবেন। তিনি নবী (সা.) এর প্রতিনিধি হিসেবে এসে মুসলমানদের দেখভাল করবেন।

লেখক : আল্লামা মাহমূদুল হাসান, খতিব, গুলশান সেন্ট্রাল জামে মসজিদ

সংঘাত নয়, শান্তি চাই -- মুফতি মুহাম্মদ আবদুল লতিফ শেখ


বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। এ দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান এবং ধর্মভীরু। তারা ধর্মকে নিজেদের মাঝে লালন করতে ভালোবাসে। কিন্তু অনেক সময় কুশিক্ষার কারণে অনেকে ইসলামের মূল সৌন্দর্য বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তখন তারা না বুঝে ইসলামবিরোধী কিছু কাজও করে বসে। অনেক সময় না জানার কারণে গর্হিত কাজ করাকে তারা নিজেদের ধর্মের জন্য ক্ষতিকর বলেও মনে করে না। সম্প্রতি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংস অবস্থা দেখে কষ্ট হয়।

অথচ মুসলমানদের কথা-কাজ, আচার-ব্যবহার, লেনদেন সবকিছুই হওয়া কর্তব্য বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ অনুযায়ী। বিশ্বনবীর উম্মত দাবি করে তার আদর্শ অনুযায়ী জীবন না গড়া নিজের সঙ্গেই প্রতারণা করার শামিল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।' (সূরা আহজাব : ২১)। একজন মুসলিমের কর্তব্য হলো, জীবনের সব ক্ষেত্রে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে অনুসরণ করা। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবন তথা সবক্ষেত্রে নববি আদর্শকে বাস্তবায়ন করাই মুসলিমের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া কর্তব্য।

আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে শান্তি ও সম্প্রীতির বাণী শোনাতে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবিধান তথা ইসলাম দিয়ে আমাদের মাঝে প্রেরণ করেছেন। তাঁর আগমনের আগে এ বিশ্বে ভয়ানক অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। গোত্রে গোত্রে হিংসা-বিদ্বেষ আর মারামারি-হানাহানি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। খুনের বদলা খুন ছিল তখনকার রীতি। নবুয়ত লাভের আগেই মহানবী (সা.) জাতিকে একটি অহিংস এবং সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজ উপহার দিতে গঠন করেছিলেন একটি সামাজিক শান্তি সংঘ। যার নাম হিলফুল ফুজুল। এ সংঘের মূল কাজ ছিল সামাজিক জননিরাপত্তার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা। হিজরতের পরে মদিনায় গিয়ে তিনি আউস ও খাজরাজ গোত্রের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যুদ্ধকে বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা সর্বজনবিদিত। শুধু তাই নয়, সপ্তম হিজরিতে কোরাইশরা যখন মুসলমানদের মক্কায় ঢুকতে বাধা দিয়েছিল তখন তিনি তাদের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে বরং সন্ধি করেছিলেন, যা ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। আজ আমরা যারা নিজেদের উম্মতে মুহাম্মদি বলে দাবি করছি, মহানবী (সা.) এর জীবন থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করা একান্ত জরুরি।

আমরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছি মুসলিম বলে। অথচ কাজ করছি ইসলামের সুমহান আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলাম মানে আল্লাহর কাছে আত্মসমপর্ণ করা, ইসলাম মানে শান্তি। ইসলাম এসেছে শান্তির মহান বার্তা নিয়ে। আল কোরআনে বলা হয়েছে, 'আর তোমরা স্মরণ করো আল্লাহর নেয়ামতের কথা, তোমরা ছিলে পরস্পর পরস্পরের শত্রু। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নেয়ামত ইসলামের মাধ্যমে তোমাদের ভাই ভাই বানিয়ে দিলেন।' (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)। শান্তির ধর্মের অনুসারী মুসলিমরা কখনও শান্তি বিনষ্ট করে এমন কাজ করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমরা জমিনে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তাতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করো না।' (সূরা আরাফ : ৫৬)। তাই তো ইসলামে অরাজকতা বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করাকে হারাম বলা হয়েছে। এমনকি সামাজিক কোন্দল ও বিশৃঙ্খলাকে হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'ফেতনা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়ে জঘন্য অপরাধ।' (সূরা বাকারা : ১৯১)। মানুষ হত্যার অপরাধের শাস্তি বড় ভয়াবহভাবে কোরআনে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন_ আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মোমিনকে হত্যা করবে তার পরিণতি হলো স্থায়ীভাবে জাহান্নাম। আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি ক্রোধান্বিত থাকবেন, তার প্রতি অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য প্রস্তুত করে রাখবেন ভয়ানক শাস্তি।' (সূরা নিসা : ৯৩)। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, 'যে ব্যক্তি কোনো মানুষের হত্যার বিনিময় ছাড়া বা জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া হত্যা করল সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল।' (সূরা মায়েদা : ৩২)। মহানবী (সা.) বিদায় হজে মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তার ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'এই পবিত্র নগরীতে, এই পবিত্র মাসে, এই দিন (কোরবানির দিন) যেমন পবিত্র, তোমাদের একের কাছে অন্যের জান, মাল ও ইজ্জত ঠিক তদ্রূপ পবিত্র।' (বোখারি : ৬৭)। এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, 'মুসলমানকে গালি দেয়া পাপের কাজ আর তাকে হত্যা করা কুফরি।' (বোখারি : ৪৮)। অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে, 'প্রকৃত মুসলিম ওই ব্যক্তি, যার হাত ও জবানের কষ্ট থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ থাকে।' (বোখাার : ১০)।

ইসলাম বলে, 'ফরজ কাজের পরে সর্বোত্তম কাজ হলো একজন মোমিনের হৃদয়ে আনন্দ প্রবেশ করানো।' (তাবরানি : ৭৯১১)। তাই জনগণের স্বার্থ ও শান্তির কথা মাথায় রেখে দেশের চলমান পরিস্থিতি বন্ধ করা দেশের নেতাদের চলমান সময়ের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। গুটি কয়েক মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষ কেন প্রাণ দেবে? আমি মনে করি, শাসকগোষ্ঠী ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য যখন সাধারণ জনগণের মনে শান্তি দেয়া, তাদের মুখে হাসি ফোটানো তবে কেন এ পরিস্থিতি এতদিন বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় দেশের রাজনৈতিক নেতাদের উচিত জ্ঞানী-গুণীদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনায় বসে পরামর্শের ভিত্তিতে এ সঙ্কটের সমাধান করা এবং দেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। যদি জনগণের শান্তির জন্য কেউ ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিতে না পারে তবে সে রাজনীতি করবে কেন? তাই সহিংসতা নয়, বরং আলোচনার টেবিলে বসে মতবিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলো সমাধান করা কর্তব্য। কেননা, জরুরি মুহূর্তে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ইসলামের আদেশ। মুসলিম হিসেবে এ আদেশ আমাদের পালন করা কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, মুসলিমদের কাজগুলো পরামর্শের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। (সূরা শুরা : ৩৮)।

মনে রাখা দরকার, ইসলামের কিছু বিধান মান্য করা আর কিছু বিধান অমান্য করা কখনোই কাম্য হতে পারে না। বরং এরূপ যারা করে তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমরা কি কেতাবের কিছু বিধান বিশ্বাস করছো আর কিছু বিধানকে অস্বীকার করছো? তোমাদের মধ্যে যে এরূপ করবে তার পরিণতি দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে তাকে কঠিন আজাবে নিপতিত করা হবে।' (সূরা বাকারা : ৮৫)। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির মতো ইসলামবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকা


লেখক : মুফতি মুহাম্মদ আবদুল লতিফ শেখ, প্রধান মোহাদ্দেস, দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা

ধর্ম সুন্দর জীবনের জন্য 

জাপান সুপার অর্থনীতির দেশ। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ও মানবীয় দক্ষতায় তারা চরম উন্নতির শীর্ষে অবস্থান করছে। কিন্তু তাদের মনে শান্তি নেই। কারণ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে জাপানে। তারা শান্তির জন্য অ্যালকোহলের আশ্রয় নেয়; কিন্তু ধর্মকে মানার কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই। অথচ একমাত্র ধর্মই পারে মানুষের জীবনে প্রশান্তি আনতে।

তবে যে মানুষটি প্রকৃত সত্য সন্ধানী, সে একদিন ধর্মের উৎসের সন্ধান পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আল্লাহকে বিশ্বাস করতেন না। তিনি ধর্ম বিশ্বাসীদের উপহাস করতেন। কিন্তু এ মানুষটি শেষ বয়সে এসে ধর্মকে জানার জন্য সারা দিন শুধু কোরআন পড়তেন। অডিও ক্যাসেটে কোরআন শোনা ছাড়া তার ঘুম আসত না। তিনি অনেক পরে হলেও আল্লাহকে চিনতে পেরেছিলেন।

বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ধর্মপ্রাণ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ পবিত্র কোরআনের সূরা আলে ইমরানের ১৯নং আয়াতে বর্ণিত 'নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম হলো ইসলাম'_ অনুযায়ী তারা ইসলাম ধর্ম পালন করে থাকেন।

ইসলাম কালজয়ী আদর্শ। যুগে যুগে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা অন্যান্য ধর্মের মানুষকে ইসলামী জীবন বিধান সম্পর্কে অবগত করত। কিন্তু বর্তমানে মুসলমানরা ধর্ম থেকে দূরে সরে যাওয়ায় মুসলমানদেরই ইসলামী জীবনবিধানগুলো মনে করিয়ে দিতে হয়।

আজ তাদের মধ্যে ইসলামী আদর্শ ঠিকভাবে না থাকার কারণে মুসলমানদের একটি অংশ অন্য ধর্ম সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে। এ যেমন মাংস শব্দটি নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। মাংস বলতে মায়ের অংশ বলে মনে করা হয়। সত্যি কি তাই? বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক অভিধানে মাংস শব্দের অর্থ হিসেবে গোশত লেখা রয়েছে। সেখানে তো মায়ের অংশ লেখা নেই। সন্ধি বিচ্ছেদ করলেও তো এখানে অংশ শব্দটি নেই। অথচ মাংস নয় গোশত শব্দটিকে ইসলাম সমর্থিত বলে ধরা হয়। মুসলিম সমাজে কেউ মাংস বললে অনেক ক্ষেত্রে তার সমালোচনা করা হয়।

একজন মানুষ কি ইচ্ছে করে কোনো হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়? তাহলে কেন একজন হিন্দু ধর্মের অনুসারীকে মালাউন বা অভিশপ্ত বলা হবে? আমরা ইসলাম সম্পর্কে জানার পর অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানি না। নিজের ধর্মকে পালন করার পাশাপাশি অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি' বিভাগ খোলা হয়।

মানুষ যা খুশি করুক না কেন? একসময় সে ধর্মের কাছেই ফিরে আসে। তাই একমাত্র ধর্মচর্চাই পারে মানবজীবনকে সুন্দর করতে।

© অধ্যাপক ড. কাজী নুরুল ইসলাম
বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : তৌফিকুল ইসলাম

বাক্য বিনিময়ের ধর্মীয় রীতিনীতি 

যেসব বিষয় মানুষকে অন্যান্য প্রাণিকুল থেকে নির্বাচিত করে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করে; বাক ও বোধশক্তি এর অন্যতম। সৃষ্টিজগতের মধ্যে মানুষেরই কেবল বাকশক্তি রয়েছে। মনের ভেতরের ঘূর্ণায়মান কল্পনা-অনুভূতিকে মানুষ বাকযন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই অন্যের কাছে প্রকাশ করে। নিজের প্রয়োজনের কথা, হৃদয়ের গহিনে থাকা অনুভূতির কথা এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতও প্রকাশ করার উত্তম মাধ্যম হলো বাকযন্ত্র। ভাষার সর্বোত্তম ব্যবহারে মুহূর্তের মধ্যে কারো মন জয় করা যায়। আবার এ ভাষা দিয়েই অন্যের হৃদয়ে কম্পন ও রক্তক্ষরণ করা যায়। গালাগাল, বল্গাহীন কথাবার্তা, বাচালতা, যাচ্ছেতাই বলে যাওয়া কেবল ধর্মবিরোধীই নয়; যেকোনো সভ্যতা, আদর্শ ও সুরুচিপূর্ণ ব্যক্তির দৃষ্টিতেও নিন্দনীয়। শাশ্বত জীবনব্যবস্থা ইসলামে পারস্পরিক বাক্য বিনিময়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে।

অনাবশ্যক কথাবার্তা পরিহার করা উচিত
মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা অহেতুক কম ও কথা থেকে বিরত থাকেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়ী, যারা অসার ক্রিয়াকলাপ বা অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে।' (সুরা : মুমিনুন, আয়াত ১-৩)। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 'ব্যক্তির জীবনে ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় তার অহেতুক কথা ও কর্ম ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে।'

মূলত সাবলীল, প্রাঞ্জল কথাবার্তা আভিজাত্যের পরিচায়ক। উত্তম কথায় মানব মর্যাদা উন্নত হয়। ব্যক্তিত্বের স্তরও নির্ধারিত হয় এ কথার মাধ্যমে। যদিও কখনো কখনো এ কথাই বহু বিপদ টেনে আনে, মানব মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, নিজের জীবন-জীবিকার মাধ্যমগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই ইসলামে বাক সংযমের কথা বলা হয়েছে। 'মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা সংরক্ষণের জন্য তার নিকটেই তৎপর প্রহরী রয়েছে।' (সুরা ক্বফ, আয়াত ১৮)।

ভিন্নমতাদর্শীদের ব্যাপারে চাই সতর্ক শব্দ প্রয়োগ
ধর্ম-বর্ণ-ভাষা এবং চিন্তা ও আদর্শগত পার্থক্য আল্লাহর অসীম কুদরতের পরিচায়ক। সৃষ্টির এ বৈচিত্র্য প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও আদর্শিক ফারাক থাকলেও মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে নম্র, কোমল, শালীন ও শিষ্টাচারপূর্ণ পন্থায়। খোদাদ্রোহী ফেরআউনের কাছে যখন মুসা ও হারুন (আ.)-কে পাঠানো হয়, তখন এ বিশেষ হেদায়েত দেওয়া হয়েছিল, 'তোমরা তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।' (সুরা ত্ব-হা, আয়াত ৪৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, 'তোমরা উত্তম পন্থায় (সৌজন্যের সঙ্গে ও যুক্তিসংগতভাবে) আহলে কিতাবের সঙ্গে তর্ক করবে।' (সুরা আনকাবুত, আয়াত ৪৬)।

সম্মানিতদের অপমান করা যাবে না
বড় ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে একটি হাদিস খুবই প্রসিদ্ধ। 'যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না, সে আমার উম্মত নয়।'
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, " 'কাব্বির', 'কাব্বির'- বড়কে শ্রদ্ধা করো। বড়কে শ্রদ্ধা করো।" (বোখারি ও মুসলিম)।
অন্য হাদিসে এসেছে, 'তোমরা মানুষদের তাদের স্ব স্ব মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করো।' (আবু দাউদ)

কাউকে মন্দ নামে ভূষিত করা নিন্দনীয়
কাউকে কটাক্ষ করা, উপহাস করা, কারো দিকে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করা এবং মন্দ বিশেষণে কাউকে ভূষিত করা ইসলামে খুবই গর্হিত অপরাধ। 'তোমরা একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না; ইমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা অতি নিন্দনীয়।' (সুরা হুজুরাত, আয়াত ১১)।

মৃতদের নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি নিষিদ্ধ
সম্প্রতি আমাদের দেশে মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি, তাদের ব্যাপারে অশালীন বাক্য ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে গেছে। অথচ একাধিক হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা আছে, 'তোমরা মৃতদের গালি দিয়ো না।' অন্য হাদিসে এসেছে 'ভালো বিষয় ব্যতীত মন্দ বিষয়ে মৃতদের নিয়ে আলোচনা করো না।' মুসলিমপ্রধান এ দেশের নেতা-নেত্রীরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবেন, এমনটাই সবার কাম্য। আর তাঁদের মধ্যকার ক্রমসম্প্রসারমাণ বিরোধ নিরসনেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, শালীন আচরণ, সংযত বাক্য বিনিময় সময়ের অপরিহার্য দাবি।

লেখক : কাসেম শরীফ, গবেষক, সাংবাদিক

জিহাদের নামে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা তরুণদের ধ্বংস করছে

আল্লাহ-জাল্লা-শানুহুর কুরআন ও রসুল মকবুল (সা.)-এর সুন্নাহর নির্ভেজাল অনুসারী মুসলমানদের চারপাশে স্বধর্মের দাবিদার তথাকথিত মুসলিমদের উদ্ভাবিত ফেতনার উপদ্রব আজ নতুন নয়। কিন্তু ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে যেসব নব্য ফেতনার উদ্ভব ঘটেছে, তার মধ্যে জিহাদকেন্দ্রিক ফেতনাটি রীতিমতো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। আল্লাহ পাক আখেরি নবীর উম্মতদের মধ্য হতে তার নিজের ধর্ম ইসলাম অবলম্বনকারীদের নামকরণ করেছেন মুসলিম। আল্লাহ তায়ালার দুদরতী জবানের ভাষ্যমতে— প্রকৃত মুসলমান তারাই, যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পাক দরবার হতে তার বিশেষ ফেরেশতা জিব্রাইল আমিনের মারফত ওহিরূপে যে সমস্ত বিধান রসুলে খোদা (সা.)-এর ওপর নাজেল করেছেন, তা শতভাগ মুখে স্বীকার এবং অন্তরের অন্তস্তলে বিশ্বাস করে তদনুসারে জীবনযাত্রা পরিচালনা করে। আর তাদের দ্বারা দুনিয়ার জমিন থেকে কুফরের প্রাধান্য দমন করে শাশ্বত সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলমানদের জন্য জিহাদ ফরজ করে দিলেন। শুধু তা-ই নয়, জিহাদকে এক অবর্ণনীয় সীমাহীন দ্বিমুখী নেয়ামত বলে ঘোষণা করলেন।

জিহাদের ময়দানে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ ত্যাগকারীকে বললেন শহীদ আর শহীদানরা শুধু বিনা হিসাবে জান্নাতই লাভ করবেন না, তাদের পবিত্র লাস কাফনসহ কিয়ামত অবধি কবর দেশে অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান থাকবে এবং বরযোখের জীবনে শহীদানরা আল্লাহ পাকের দরবার হতে রীতিমতো রিজিক লাভ করে থাকেন। অপরদিকে জিহাদে জয়লাভকারী সৈনিকদের উপাধি দিলেন গাজী। তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবন সর্বোচ্চ সাফল্যমণ্ডিত।

কিন্তু আজ যারা জিহাদের কথা বলে কোমলমতি মাদ্রাসার ছাত্র, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং ছাত্র নয় এমন অনেক তরুণ-তরুণীকে শিক্ষা-দীক্ষা পিতা-মাতা আত্মীয়স্বজন নির্বিশেষে সভ্য শিক্ষিত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সাক্ষাত্ ধ্বংসের গহবরে ঠেলে দিচ্ছে। তারা কারা? তাদের মধ্যে তো মুসলমানিত্বের মমেরও বিন্দুমাত্র চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ আল্লাহ পাক জিহাদ ফরজ করেছেন কুফরের বিরুদ্ধে ঈমানদার মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব হিসাবে। আর ঈমানদার তারা, যারা ঈমানদারিত্বে মৌলিক বিধানগুলোর সব কয়টিই পরিপূর্ণভাবে মৌখিক প্রকাশ ও তদনুসারে জীবনযাত্রা পরিচালনা করে। এই মর্মে আল্লাহ পাক বলেন— “রাসুল বিশ্বাস করেন ঐ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যা তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, তার গ্রন্থসমূহের প্রতি এবং তার পয়গম্বরগণের প্রতি। তারা বলে, আমরা তার পয়গম্বরগণের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না। তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার কাছে ক্ষমা চাই। হে আমাদের পালনকর্তা। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” সূরা আল বাকারাহ (২৮৫)।

আজ যারা ঘটা করে কোমলমতি তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জিহাদে অবতীর্ণ হতে আহবান করছে, কুরআন-হাদিসের আলোকে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে তারা কারা? তারা তো অভিশপ্ত জঙ্গি-সন্ত্রাসী ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ আল্লাহর তরফ থেকে এই সমস্ত মৌলিক বিধান সর্বান্তকরণে মাননেওয়ালা ও পালন করনেওয়ালা রসুলপ্রেমিক খাঁটি মুসলমানদের চেয়েও জোরেশোরে বলে বেড়ায় ঐ ভয়ঙ্কর জঙ্গি সন্ত্রাসীরা। কিন্তু ওদের কাজে-কর্মে তিলমাত্র মানার প্রমাণ মেলে না। ওদের কার্যকলাপ ঐ সমস্ত খোদায়ী বিধানের শতভাগ বিরোধী। ওরা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাজের সমালোচনাকারী (নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহ তাআলা সব ধরনের জুলুমের ঊর্ধ্বে। অথচ এরা আল্লাহর আইন যিনা করার শাস্তি রজমকে নিঃসন্দেহে জুলুম বলে উল্লেখ করেছে। কুরআন শরীফ সম্পকে কটূক্তি করেছে। যেখানে আল্লাহ তা’আলা নিজে তার নবী-রসুলগণকে নিষ্পাপ ঘোষণা করেছেন, সেখানে এই ধর্মদ্রোহীরা বলছে নবীগণ নিষ্পাপ নন, প্রত্যেক নবী গুনাহ করেছেন।

বর্ণাঢ্য জীবনযাত্রা পরিচালনাকারী একজন নবী হযরত ইউসুফ (আ:) ?যিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয়ভাজন স্নেহভাজন নবী। তাকে ওরা এইভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে যে, তিনি শুধু একজন স্বৈরশাসকই নন, বরং ইতালির মুসোলিনির মতো একজন ডিক্টেটর (নাউজুবিল্লাহ)। যেখানে স্বয়ং আল্লাহ পাক ঈমানের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম (রা:)দের ঈমানকে, অর্থাত্ সাহাবায়ে কেরামদের মতো ঈমানদার হতে হবে। অন্যথায় কারো মনগড়া ঈমানকে ঈমান বলে গণ্য করা হবে না এবং ঈমানদারকে ঈমানদার হিসেবে গণ্য করা হবে না। অর্থাত্ ঐ বেঈমানরা বলছে সাহাবায়ে কেরাম (রা) সত্যের মাপকাঠি নন এবং তারা অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য নন। হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে ওরা বলছে, তিনি এমন কিছু কাজ করেছেন যাকে অন্যায় বলা ছাড়া উপায় নেই। এসব ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্যের ব্যাপারে স্বচ্ছ আয়নার ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেছে ওরা কারা। ওরা তারা, যাদের ফেতনা কাদিয়ানি ফেতনার চেয়েও ভয়ঙ্কর!

সুতরাং হে ঈমানদার মুসলিম ভ্রাতা-ভগ্নিগণ, হে আগামী দিনের আসার আলোকবর্তিকা তরুণ-তরুণী— ওদের আহবানে চুল পরিমাণ সাড়া দিও না। হে সোনার ছেলে-মেয়ের জনক-জননীর অভিভাবকবৃন্দ, এখনই ওদের থেকে চিরতরে মুখ ফিরিয়ে নাও। ওরা ধার্মিক নয়, ধমদ্রোহী, ঈমানদার নয়— বেঈমান। আল্লাহর কুরআন ও রসুল (সা.)-এর হাদিসের আলোকে ওরা জঙ্গি, ওরা মহাসন্ত্রাসী! ওদের বিরুদ্ধাচরণ করা ঈমানি দায়িত্ব। ওদের ত্যাগ করে নিজে বাঁচ, আহালকে বাঁচাও।

লেখক: মো. শাহ্জাহান, মুক্তিযোদ্ধা, ইঞ্জিনিয়ার ও কবি

জঙ্গিবাদ কারা সৃষ্টি করল?

আমাদের দেশে মাঝে-মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গি দলগুলো। পত্র-পত্রিকায় পাতার পর পাতা লেখা হয় তাদের নিয়ে জঙ্গি-কাহিনী। বিদেশি দূতদের ঘন ঘন হয় সভা-সেমিনার। রাজনীতিবিদরাও তাদের সাথে ভোজসভায় মিলিত হন। এমনকি বিচারকরাও আগ্রহসহকারে মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনে থাকেন। বাতাসে গুঞ্জন আছে— এর পিছনে অন্য কোনো খেলা কাজ করে। প্রভুদের কথা আমাদের কাছে বেদবাক্যের মতো। আর হবেই বা না কেন? আমরা যে গরিব! তাদের টাকায়, দান-খয়রাতে আমাদের অর্থনীতি চলে। মোড়ল রাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক সেই খাতক-মহাজনের মতো— যে খাতক বৃদ্ধ মহাজনের মন রাখতে নিজ নাবালিকা কন্যাকে মহাজনের হাতে তুলে দিতে হতো এক সময়।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “সন্ত্রাসবাদ যদি মুদ্রার একপিঠ হয়, তা হলে এর অন্য পিঠেই আছে অর্থ। অর্থই সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক, অর্থই সন্ত্রাসবাদকে সম্ভব করে, অর্থই সন্ত্রাসবাদের অক্সিজেন।” তিলকে তাল বানিয়ে শত্রুকে ধ্বংস করার সাম্রাজ্যবাদী নীতি আমাদের অজানা নয়। স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধঃপতন হয় মূলত ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখলকে কেন্দ্র করে। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য আফগানিস্তানের পক্ষ হয়ে অর্থ, অস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ, মোজাহেদীনদের রিক্রুট, প্রচার-প্রচারণার কাজগুলো করে দিয়েছিল।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে তখন একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাদের অতীত কার্যকলাপের ফল কিছুটা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। তাদেরই অর্থ ও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জিহাদিরা হয়ে ওঠে তাদের প্রধান শত্রু। দুঃখের বিষয় এই যে, তারা ছিল ইসলাম ধর্মের দাবিদার। দুঃখের বিষয় বললাম এই জন্য যে, তারা যদি ইসলাম না হয়ে খ্রিস্টধর্মের বা অন্য কোনো ধর্মের হতো, তবে হয়তো তাদের কপালে জঙ্গি খেতাবটা জুটত না।

‘জঙ্গ’ শব্দটা ফারসি, এর অর্থ হলো যুদ্ধ (ডধত্)। আর জঙ্গি শব্দের অর্থ যে বা যারা যুদ্ধ করে, অর্থাত্ যোদ্ধা। ইংরেজিতে ডধত্ত্রড়ত্, ঋরমযঃবত্. অর্থগত হিসেবে বিবেচনা করলে জঙ্গি শব্দের অর্থ হলো যোদ্ধা। এই হিসেবে গত এক শত বছরে শুধু আমেরিকা, ব্রিটেন, ইসরাইল এই সম্মিলিত শক্তি দুনিয়াজুড়ে কতটি যুদ্ধ করেছে, কত দেশ ধ্বংস করেছে, কত জায়গায় তাদের সামরিক ঘাঁটি গঠন করে কী পরিমাণ সামরিক অস্ত্রের মজুদ এবং সৈন্য মোতায়েন করেছে, সেই পরিসংখ্যান দাঁড় করালে পৃথিবীর সবচাইতে বড় জঙ্গি দেশ যে তারাই তা অস্বীকার করা হবে সত্যের অপলাপ।

যা হোক, কথিত এই নতুন জঙ্গিদের ধ্বংস করার জন্য চালু করা হলো নতুন যুদ্ধ। এই উগ্রবাদীদের নতুন ‘ট্যাগ’ দেয়া হলো ‘জঙ্গি’। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত করানো হলো তাদেরই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা ওসামা বিন লাদেন। এই জঙ্গিদের কিন্তু কোনো অস্ত্রের কারখানা ছিল না। তাদের হাতের বেশির ভাগ অস্ত্রই ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই দেয়া এবং কিছুটা ছিল রাশিয়ার হাত থেকে হস্তগত করা। অন্যদিকে ‘জঙ্গিবাদের অক্সিজেন’ অর্থ-বিত্তের নিয়ন্ত্রক ও মালিক তো একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই।

ইরাক, আফগান এবং পাকিস্তানে পরিচালিত যুদ্ধের পিছনে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ৩.২ ট্রিলিয়ন থেকে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ডলারের পরিমাণ যে কী পরিমাণ তা আমাদের দেশের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। এই টাকা কোথা থেকে আসে? পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই তা জনে না। এ অর্থ লুটের মাল। সেই তারাই যখন অর্থকে জঙ্গিবাদের জোগানদাতা বলে অভিহিত করেন, তখন আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা মাথা ঝুঁকিয়ে এ কথার সায় দেন, কেউ প্রতিবাদ করেন না। কারণ আমরা গরিব। দুঃখের বিষয়, আমরা প্রভুদের প্রবর্তিত ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ (উরারফব ধহফ জঁষব) নীতির শিকার হয়ে বহুধা বিভক্ত হয়ে আছি। আমাদের নেতা-নেত্রীদের কোমরে নেই জোর। তারা নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই অন্যের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেশের ছেলে নাফিসকে তারা কথিত স্ট্রিং অপারেশনের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে আটক করল, বিচার করল, ৩০ বছর কারাদণ্ড দিল। আর তাদের ছেলে নরওয়ের ব্রেইভিক ৯২ জনকে গুলি করে হত্যা করল, বোমা ফাটাল, তাকে নামে মাত্র শাস্তি দিল মাত্র ২১ বছর। এখন তাকে আবার বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে সভ্য করানো হচ্ছে। সকলের ভালোই জানা আছে নাফিস যে অপরাধ করেছে তার পিছনে ‘অক্সিজেন’ জোগানোর কাজটি কিন্তু করেছে তাদেরই দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।

এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, তাদের মিথ্যাবাদিতা, প্রতারণামূলক চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের জ্ঞান দিতে পারেন। কারণ আমরা ঐক্যবদ্ধ নই। আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থে দলাদলি এবং কোন্দলে ডুবে আছি। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করাতে পারলেই আমরা খুশি। কিন্তু এর ফল শেষতক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি আমাদের নেতা-নেত্রীরা ভেবে দেখেছেন? তারা কি ভাবেন জঙ্গিদের অস্ত্রের জোগান কোত্থেকে আসে?

মনে রাখতে হবে এসব তারাই বিলি করছে যারা অদূর ভবিষ্যতে এসবের অজুহাতে আমাদের ওপর আক্রমণ করে আমাদের ধ্বংস করবে— অন্তত নিকট অতীত আমাদের তাই জানাচ্ছে। তখন আমাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন বেরিয়ে আসবে হামিদ কারজাই, একজন নুরে আল-মালেকী হয়ে।

আসল কথা হচ্ছে, কোমরে জোর থাকলে অন্যদের ডেকে না এনে আমরাই জঙ্গিপনা নির্মূল করতে পারতাম। তখন আমাদের বাধ্য শ্রোতার মতো তাদের মুখ থেকে এসব নীতিকথা শুনতে হতো না। আমাদের নেতা-নেত্রীরা সজাগ হবেন কি? না কি একজন হামিদ কারজাই, একজন নুরে আল-মালেকী হতেই তারা বেশি আগ্রহী?

© রিয়াদুল হাসান 

প্রকৃত ইসলামে কোনো জঙ্গিবাদ নেই

রাকীব আল হাসান : পৃথিবীব্যাপী জঙ্গিবাদ এক ভয়াবহ ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, যে ব্যাধির সংক্রমণে প্রতিনিয়ত মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে শত-সহস্র আদম সন্তান; ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও জনপদ। সব থেকে ভয়ের বিষয় হচ্ছে দিন দিন জঙ্গিদের সংখ্যা, সামর্থ্য ও ধ্বংসযজ্ঞ বেড়েই চলছে। এমন অবস্থায় এদের এ পথ থেকে সরাতে হলে সর্বপ্রথম তাদের কর্মকাণ্ড যে ভুল অর্থাত্ ইসলামবিরোধী, তা বোঝাতে হবে।

জঙ্গিদের দুটি ভুল: (১) ইসলাম সম্পর্কে তাদের সম্পূর্ণ ধারণা (আকিদা) ভুল ও বিকৃত। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে তাকে তার খলিফা, প্রতিনিধি কেন নিযুক্ত করলেন; মানুষের মধ্যে তার নিজের আত্মা কেন ফুঁকে দিলেন; পৃথিবীতে পাঠিয়ে মানুষের দেহ-আত্মার মধ্যে কেন ইবলিসকে প্রবেশ করার অনুমতি দিলেন; আবার নবী-রাসূল পাঠিয়ে মানুষকে হেদায়াহ অর্থাত্ দিকনির্দেশনা দিয়ে কী দায়িত্ব আল্লাহ দিলেন; এক কথায় মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী, ইসলাম কী এ সম্বন্ধে এই ক্ষুদ্র দলটির সঠিক আকিদা (ঈড়সঢ়ত্বযবহংরাব ঈড়হপবঢ়ঃ) নেই। অথচ তারা আল্লাহকে, তার রাসূলকে ও দীনুল ইসলামকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। আর তাই তারা ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র দাবি মোতাবেক গণতন্ত্রের সার্বভৌমত্বকে মানতে রাজি নন। তারা চান পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু যেটাকে তারা ইসলাম বলে ভাবছেন, সেটা আল্লাহ রাসূলের প্রকৃত ইসলামই নয়। গত ১৩০০ বছরে আল্লাহ রাসূলের প্রকৃত ইসলাম বিকৃত হতে হতে আজ সেটা একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। তাই এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করে আল্লাহর দীনের কোনো ‘খেদমত’ হবে না, এজন্য আল্লাহর কাছ থেকে বিনিময় আশা করাও অর্থহীন।

(২) তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছেন, তাদের সে পথ ভুল। তারা যে সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করেছেন সেই পথে চললে দুনিয়াও পাবেন না, আখেরাতও পাবেন না। অর্থাত্ দুই কূলই হারাবেন। আগে বুঝতে হবে ইসলাম অর্থাত্ সত্যদীন (দীনুল হক) কী এবং এর প্রতিষ্ঠার সঠিক প্রক্রিয়া কী? তাদের বুঝতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে যে, পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার একমাত্র সঠিক নীতি, পথ ও প্রক্রিয়া হচ্ছে শুধু সেইটা যেটা আল্লাহর রাসূল নিজে করেছেন এবং আমাদের শিখিয়ে গেছেন। ওই পথ ছাড়া আর কোনো পথে, কোনো প্রক্রিয়ায় তারা আল্লাহর সাহায্য পাচ্ছেন না এবং পাবেন না। ফলে তারা সফলও হচ্ছেন না এবং হবেন না। বিশ্বব্যাপী তাদের পরাজয় ও দুরবস্থা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাদের মুমিন হিসেবেও স্বীকার করেন না। কেননা তিনি বলেছেন, “মুমিনরা যখনই কাফেরদের সঙ্গে মোকাবিলায় অবতীর্ণ হবে, কাফেররা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। তারা কোনো অভিভাবক ও সাহায্য পাবে না। এটা আল্লাহর অপরিবর্তনীয় সুন্নাহ (রীতি), যা পূর্বকাল থেকে চলে আসছে। নিশ্চয়ই আল্লাহর সুন্নাতে কোনো পরিবর্তন নেই। (সুরা ফাতাহ ২২-২৩)

রাসূলাল্লাহ কি মক্কার ১৩ বছর কোন যুদ্ধ করেছেন? তিনি ও তার আসহাবগণ নিরবচ্ছিন্নভাবে শুধু তাওহীদের বালাগ করে গেছেন। মদীনার মানুষগুলো যখন রাসূলাল্লাহকে তাদের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে তখন একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন তিনি কিন্তু আর ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী নন— তিনি একজন রাষ্ট্রনায়ক। কাজেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শান্তি-শৃৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তখন অস্ত্র হাতে নিলে সেটা হয় সেনাবাহিনীর কাজ— সেটা সন্ত্রাস হয় না, জঙ্গিবাদ হয় না। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ব্যক্তি বা দল বা গোষ্ঠী হিসেবে অস্ত্রধারণ করা যায় না— এটা হবে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ। এই জঙ্গিবাদের কোনো স্থান ইসলামে নেই। আল্লাহ এবং তার রাসূল এ সুযোগ দেননি কাউকে। কাজেই ইসলামে কোনো জঙ্গিবাদ নেই।
ধর্ম -- 

সালাম এক মুমিনের প্রতি আরেক মুমিনের হক 

দুনিয়ার সব জাতির মধ্যে একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রথা চালু আছে। ইসলামে সালাম বিনিময় সে ধরনেই প্রথা। শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময়ে ইসলামে পারস্পরিক যে ভাষায় সম্ভাষণ করা হয় তা সর্বোত্তম।

এক মুমিনের সঙ্গে আরেক মুমিনের দেখা হলে সালাম দেওয়া একটি অবশ্য পালনীয় ইসলামী বিধান। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটিকে এক মুমিনের প্রতি আরেক মুমিনের হক বলে অভিহিত করেছেন। সালামের প্রচলন শুরু হয়েছে হজরত আদম (আ.) থেকে। বোখারি শরিফের ৭২১ নম্বর হাদিসে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন আল্লাহতায়ালা আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর একদল ফেরেশতার কাছে যেতে ও তাদের সালাম করতে বললেন। আরও বললেন তারা সালামের জবাব কীভাবে দেয় তা আপনি লক্ষ্য করবেন এবং ওই জবাব আপনার এবং আপনার বংশধরদের সালামের নিয়ম হবে। আদম (আ.) ফেরেশতাদের কাছে গিয়ে 'আসসালামু আলাইকুম' বলে সম্ভাষণ জানালেন। প্রতিউত্তরে ফেরেশতারা ওয়াআলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বললেন। এক মুসলমান অপর মুসলমানকে দেখামাত্র আসসালামু আলাইকুম অর্থাৎ 'আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক' বলে সম্ভাষণ করে। এ সম্ভাষণের মাধ্যমে পরিচিত, অপরিচিত, গরিব, ধনি, বয়স্ক, শিশু সবার শুভ কামনা করা হয়। এ সম্ভাষণ এক মুসলমানকে অপর মুসলমানের সঙ্গে আত্দিক সম্পর্কে আবদ্ধ করে। এ সম্ভাষণের জবাব হিসেবে ওয়াআলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বা আপনার ওপর শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক বলে শুভ কামনা করা হয়। যা আত্দিক সম্পর্ক স্থাপনেরই তাগিদ দেয়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারও সঙ্গে দেখা হলে সর্বাগ্রে তাকে সালাম দেওয়া পছন্দ করতেন। এমনকি তিনি শিশুদেরও সালাম দিতেন।

আবু হুরাইয়া (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত মুমিন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না। আমি তোমাদের এমন একটি বিষয়ের কথা বলব, যাতে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার সৃষ্টি হবে। তোমাদের মাঝে সালামের প্রসার কর। (তিরমিজি)

লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ সাহেব আলী, ইসলামী গবেষক

মাতৃভূমির ভালোবাসায় হোক দেশ গড়া


দেশকে তুলনা করা হয় মায়ের সঙ্গে। একজন মানুষ তার মাকে যেমন ভালো না বেসে পারে না, তেমনি একজন নাগরিকের তার দেশকে ভালোবাসতেই হয়। দেশের প্রতি এ ভালোবাসাটি সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত। মোটাদাগে সবার মধ্যে দেশাত্মবোধ থাকলেও বিশেষ মুহূর্তে যারা দেশের জন্য আত্মত্যাগে পিছপা হন না তারাই দেশপ্রেমের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। পারিপার্শ্বিক নানা কারণে অনেকের মধ্যে দেশের প্রতি মমতা থাকার পরও তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। তবে যারা তাদের কর্মে ও বাস্তবতায় দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির সহায়ক হন তারাই মূলত দেশপ্রেমিক। নাগরিকদের মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের সংখ্যা যত বাড়বে দেশ তত এগিয়ে যাবে।

দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধের সহজাত বিষয়টিকে ইসলামও সবার শীর্ষে স্থান দিয়েছে। মহানবী (সা.) দেশপ্রেমের সবচেয়ে উজ্জ্বল নজির স্থাপন করে গেছেন। স্বজাতি তাকে অন্যায়ভাবে বের করে দিলেও দেশের প্রতি তার অনুরাগ ছিল প্রবাদতুল্য। মদিনায় আশ্রিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি মক্কার প্রতিই বেশি টান অনুভব করতেন। নববি আদর্শে গড়া সাহাবায়ে কেরামও ভালোবাসতেন নিজ দেশ ও মাটিকে। হিজরতের পর মদিনায় হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তাদের মনে-প্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তারা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। এ অবস্থায় নবী করিম (সা.) সাহাবিদের মনের এ দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, 'হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়েও বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন।' (বোখারি)।

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন আহ্বান করেছেন, সাহাবায়ে কেরাম সর্বতোভাবে এ ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তারা জানতেন, নিজেদের বিশ্বাস, আদর্শ ও ধর্মমত প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ভূখন্ডের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি নিবেদিত ছিলেন দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায়। ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ মানুষকে স্বদেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশপ্রেমিক নাগরিক নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। যুগে যুগে দেশপ্রেমিক নাগরিকরা নিজের সর্বস্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন ও সুরক্ষার আন্দোলন করে গেছেন।

দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবসময় নজর রাখতে হবে সামনের দিকে। জাতির অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতের পদক্ষেপই গুরুত্ব পাবে রাষ্ট্র ও নাগরিকের কাছে। কোনো জাতির অতীত ক্লেদাক্ত হলেও ভবিষ্যৎ যেন সুরভিত হয় সে দিকে নজর রাখতে হবে কর্তাব্যক্তিদের। জাতীয় নেতৃত্বের জন্য সহনশীলতার গুণটি অপরিহার্য। ইসলামের প্রেরণা হলো ক্ষমা, সহিষ্ণুতা ও সহনশীল আচরণ। কারণ এ গুণগুলো জাতীয় জীবনে সামনে চলার প্রেরণা জোগায়, অতীতের অন্ধকারে ফিরে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। ইসলামের নবী মক্কা থেকে বিতাড়িত হলেন। কয়েক বছরের মাথায় বিজয়ী হয়ে তিনি যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তার মুখে ছিল ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার বাণী। অতীতে তার সঙ্গে কে কেমন আচরণ করেছেন সব তার চোখের সামনে। তবুও তিনি দেশ ও জাতির এগিয়ে চলার স্বার্থে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসামূলক কোনো পদক্ষেপ নেননি। এতে রাষ্ট্রের কাঠামো আরও সবল হয়েছে। বিরোধী শক্তিও সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা থাকার পরও এর অপব্যবহার না করে উদারতার হাত বাড়িয়ে দেয়া অনেক মহৎ গুণ।

© জহির উদ্দিন বাবর

ইসলাম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সমর্থন করে না ইসলাম শান্তি, কল্যাণ ও প্রগতির ধর্ম, সন্ত্রাসের নয়। ইসলাম ধর্মে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। উগ্র জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী দানবীয় শক্তি সামাজিক পরিমণ্ডলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। দেশে ধর্মীয় মুখোশধারী অপশক্তির অপকর্ম সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। তবে বলাই বাহুল্য, ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে যথাসময়ে দমন করতে না পারলে রাষ্ট্রকে এর জন্য বড় রকম খেসারত দিতে হবে। ইসলামী জামায়াত ও সংগঠনগুলোর মধ্যে যেগুলো ধর্ম ও রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে বেড়ায় এবং দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে, তাদের নিষিদ্ধ করা দরকার। উগ্রপন্থী জঙ্গিবাদ এবং চরমপন্থী রাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনগুলোর রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কার্যক্রম দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। যারা রাষ্ট্রে জঙ্গিপনা সৃষ্টি করে, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়, তারা কি কখনো গণতান্ত্রিক শক্তি হতে পারে? বস্তুত এ ধরনের অগণতান্ত্রিক অশুভ শক্তি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনার পরিবর্তে রাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত করে, রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে, রাষ্ট্রের ভিতকেই অবশেষে নড়িয়ে দিতে পারে এবং সমগ্র দেশে অশুভ শক্তির মদদে কায়েমি স্বার্থবাদী মহল অশান্তির অনলকুণ্ড প্রজ্বলিত করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে। সমাজের সচেতন শুভ নাগরিক শক্তিকে এখনই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটতে পারে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের নামে বেপরোয়া গাড়ি ভাঙচুর এবং পুলিশের ওপর অতর্কিতে হামলা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ত্রাস সৃষ্টির অনুমতি শাশ্বত সত্য ধর্ম ইসলাম এবং কোনো সভ্য রাষ্ট্র দেশের নাগরিককে দেয় না। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র কস্মিনকালেও জঙ্গিবাদকে রাষ্ট্রে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার সুযোগ দিতে পারে না। সুসভ্য মানুষ অসভ্য বর্বর জঙ্গি সন্ত্রাসী চক্রের উত্থান ঠেকাতে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। জঙ্গিবাদ মূলত আইন অমান্যকারী ও রাষ্ট্রদ্রোহী কট্টরপন্থী অপশক্তি। ইসলামী পরিমণ্ডলে যাদের কোনো স্থান নেই। সমাজবিরোধী অপশক্তির কাজই হলো অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা এবং সমাজে মিথ্যাচার করা, অপবাদ ও মিথ্যা দুর্নাম রটনা করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং জাতিগত অনৈক্য ও বিভক্তি সৃষ্টি করা, ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও নাশকতা কাজে লিপ্ত থেকে জাগতিক ফায়দা লোটা। বস্তুত এরা ধর্ম রাজনীতির নামেই মন্দ কর্ম করে থাকে। গায়ের জোরে তারা তাদের ধর্মগুরু মাওলানা মওদুদীর বিকৃত মনগড়া ভ্রান্ত মতবাদ সমাজ ও রাষ্ট্রে কায়েম করতে চায়। প্রশ্ন হলো ইসলাম কি এদের ভ্রান্ত মতবাদকে সমর্থন করে? জবাবে বলা যায়, ইসলাম বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনুপম সওগাত নিয়ে এসেছে এবং মুসলমানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন তারা বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কাজেই ইসলাম সমাজবিরোধী দুষ্টচক্রের নৈতিকতাবর্জিত এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের শাস্তি ইসলামে ভয়ংকর। রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্যও কঠিন দণ্ডের আদেশ রয়েছে। আজ যারা শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে বিভিন্ন ইসলামী জামায়াত, দল ও সংগঠন কায়েম করে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে, তাদের ব্যাপারে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। আজ যারা রাজনৈতিক অঙ্গনে জঙ্গিপনা করছে এবং নাশকতা করছে, চোরাগোপ্তা হামলা করছে, ছাত্রদের হাত-পায়ের রগ কেটে দিচ্ছে, নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা করছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চড়াও হচ্ছে, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে রাষ্ট্র ও জনগণের ক্ষয়ক্ষতি করছে, জনজীবনে অশান্তি ও অস্থিরতা সৃৃষ্টি করে চলছে, তাদের অবদমিত করা সময়ের অনিবার্য দাবি। দেশে জামায়াত-শিবির চক্রকে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে গৃহযুদ্ধের ইন্ধন জোগাচ্ছে এবং রাষ্ট্রকে অচল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে এবং হরতালের নামে জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস ও নাশকতা করতে সায় দিচ্ছে, তারা উভয়ে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত। কোনো রাজনৈতিক শক্তি দাবি আদায়ের জন্য সন্ত্রাস ও নাশকতামূলক কাজ করে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির উদ্ভব করতে পারে না। যদি কেউ অন্যায়ভাবে অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করে, তাহলে প্রচলিত আইনে এই অন্যায় দুষ্কর্মের বিচার করা জরুরি দরকার। আল্লাহ মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপদে বসবাস করে এবং বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি না করে। আল্লাহ বলেন, 'এবং তাদের বলা হয় যে, তোমরা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না, তারা বলে আমরা তো কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী। সতর্ক হও! নিশ্চয়ই তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা এটা বোঝে না' (সুরা বাকারা: ১২, ১৩ আয়াত)। ইসলাম তার অভ্যুদয়ের সূচনালগ্ন থেকেই কায়েমি স্বার্থবাদী সমাজবিরোধী দুষ্টচক্র ও সন্ত্রাসী দানবীয় শক্তির প্রচণ্ড বিরোধিতার মোকাবিলা করে এসেছে। ইসলাম বারবার আক্রান্ত হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে, ইসলামের খাঁটি অনুসারীরা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, গৃহহারা হয়েছেন, সমাজচ্যুত হয়েছেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তবু সত্যিকারের রসুল (সা.) প্রেমিক মুসলমানগণ রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ও সংবিধান অমান্য করেননি এবং কোনো রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজে লিপ্ত হননি। তাঁরা সরকারবিরোধিতার নামে কখনো হরতাল পালন করেননি এবং জঙ্গি মিছিল বের করেননি, গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেননি। কারণ, ইসলাম নিষেধ করেছে এসব অপকর্ম করার জন্য। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বদেশপ্রেম ইমান বা বিশ্বাসের অঙ্গ। মুসলমানগণ যে দেশের নাগরিক, সেই দেশকে ভালোবাসতে এবং দেশের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে বলা হয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি অবশ্যই আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে। ধর্মীয় আকিদাগত কারণে দমন-পীড়নের শিকার হলেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার সুযোগ নেই। তবে এই এ ক্ষেত্রে দ্বীনকে দুনিয়ার ওপর প্রাধান্য দেওয়ার নীতির প্রতিফলন ঘটবে শান্তিময় পথে আদর্শ উপস্থাপনের মাধ্যমে। কিন্তু কোনোক্রমেই জঙ্গিপনা ও সন্ত্রাসী কাজের অনুমতি ইসলামে নেই। ইসলাম সর্বদা আত্মরক্ষার অনুমতি দেয়, তবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে এ আদেশ পালন করতে বলা হয়েছে। প্রকৃত কোনো ধর্মভিত্তিক মানবিক চেতনায় উদ্দীপ্ত আধ্যাত্মিক জামায়াত বা সংগঠন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে না এবং বহিঃশত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠতে পারে না। এমনকি হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে ত্রাস সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে না। যদি এর বিপরীত সন্ত্রাস ও নাশকতা কাজে কোনো ধর্মভিত্তিক দল ও জামায়াত লিপ্ত হয় এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে বুঝতে হবে, এরা ইসলামবিরোধী অপশক্তি। গণতান্ত্রিক সরকার ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্বলিত করে দেশে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অপতৎপরতায় কেউ লিপ্ত হলে, তাদের সমূলে উচ্ছেদ করা সরকারের দায়িত্ব। নগরভিত্তিক মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেসব মুসলিমবিদ্বেষী চরমপন্থী ইহুদি মক্কার কোরাইশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে মুসলমানদের সমূলে উচ্ছেদ ও নির্বিচারে নিধন করে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের সেদিন মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের জন্য ইসলাম কঠিন দণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। সেদিন মদিনা সনদ (যা লিখিত প্রথম সংবিধান)-এর চুক্তি ভঙ্গ করে ইহুদি সম্প্রদায় বদর যুদ্ধের সূচনা করে, মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলোপের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, সেদিন ইহুদি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং ওলামাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণিত হওয়ায় অনেককে কঠিন দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী রাষ্ট্রদ্রোহী দেশ ও জাতির শত্রু হিসেবে যেসব দল ও সংগঠন চিহ্নিত রাষ্ট্র তাদের বিচার করতে পারে। এখানে আপত্তি তোলার কোনো সুযোগ নেই। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের মামলায় আটককৃত জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মুক্তি ও ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতে হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচির নামে সহিংস তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে। তারা রাস্তায় নেমে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হাতবোমা নিক্ষেপ করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। উদ্দেশ্য কেবল একটাই, এদের নাশকতামূলক কাজে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেশের জনগণ ও বিচারসংশ্লিষ্টরা এ বিচার থেকে পিছ পা হয়ে পড়বে। কিন্তু এদের আশায় গুড়ে বালি। এমনটি কখনো হবার নয়। তবে জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বিচার বানচাল বা বাধাগ্রস্ত করার পরিস্থিতি তৈরি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। জামায়াত-শিবির যে হামলা ও নাশকতা চালাচ্ছে, তা জননিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে, যা চলতে দেওয়া সংগত হবে না। রাষ্ট্র যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটককৃত জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিচার কাজ সম্পন্ন করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত, তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ বানচালের চেষ্টা করা এবং বিচার বন্ধের অন্যায় দাবি তোলা কি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধজনক কাজ নয়? বস্তুত ইসলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম যেন ধর্ম নির্দেশিত ও আন্তর্জাতিক মানের হয়, সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে। রাষ্ট্র বিচার বানচাল ও বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা থেকে সংশ্লিষ্ট সব মহলকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে রাস্তায় নেমে হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচির নামে সহিংস তৎপরতা চালানো এবং নাশকতা কাজ করে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির উদ্ভব করা অন্যায় গর্হিত কাজ। জামায়াত-শিবিরের কর্মসূচিতে একটি বড় দল প্রকাশ্যে সমর্থন জুুগিয়ে প্রকারান্তরে এটাই প্রমাণ করছে যে তারা আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য নিন্দা না জানিয়ে তাদের রাজনৈতিক হরতাল কর্মসূচিতে সমর্থন জানিয়ে বড় একটি দল আবারও প্রমাণ করল, তারা জামায়াত নেতাদের বিচার ট্রাইব্যুনালে হোক, এটা চায় না। অতীত ভুলের জন্য যখন জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া হয় না এবং রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে গড়িমসি করা হয়, তখন রাষ্ট্র মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ধরে আইনের কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান করে কঠিন দণ্ডাদেশ দিলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। জামায়াত-শিবিরের ন্যায় কোনো উগ্রবাদী চরমপন্থী সংগঠনের দ্বারাই কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ঘৃণ্যতম নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলা এবং গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে পারে। বস্তুত পুলিশ বাহিনীর ওপর হামলা করে আতংক ছড়িয়ে দেওয়া এবং তাদের প্রকারান্তরে দুর্বল ও অবদমিত করার জন্যই এই পরিকল্পিত হামলা। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্র যাদের ওপর ন্যস্ত করেছে, তাদের ওপর হামলা করে মনোবল ভেঙে দেওয়া হলে রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে জামায়াত-শিবির। একমাত্র জঙ্গি সংগঠন ছাড়া অন্য দল ও সংগঠন রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে আইনের বারোটা বাজাতে পারে না। জঙ্গিবাদ ও উগ্রমৌলবাদ আইন ও সংবিধানবিরোধী বলেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী পুলিশের ওপর হামলা করার দুঃসাহস দেখাতে পারছে। পুলিশভ্যানসহ সরকারি গাড়ি, যাত্রিবাহী গাড়ি, নির্বিচারে সব কিছুর ওপর শিবির হামলা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকতে পারে, শান্তিপূর্ণভাবে নানা কর্মসূচি তারা পালন করছে এবং করবে। এতে কারো আপত্তি থাকতে পারে না। তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার সুযোগ রাষ্ট্র কোনো নাগরিককেই দেয় না। রাষ্ট্র ও সরকারের অনুগত্যের বিষয়ে ইসলাম কী বলে? ইসলামের শিক্ষা হলো 'উলিল আমর' বা আদেশ দেওয়ার অধিকারী শাসককে মানতে হবে। আল্লাহ বলেন, 'হে যারা ইমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, তার রাসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের কর্তৃপক্ষেরও (আনুগত্য) করো। কিন্তু (কর্তৃপক্ষের সঙ্গে) কোনো বিষয়ে তোমরা মতভেদ করলে এ বিষয়টি আল্লাহ ও রাসুলের সমীপে উপস্থাপন করো, তোমরা যদি (সত্যিকার অর্থে) আল্লাহ ও পরকালে ইমান রাখো (সুরা নিসা: ৪:৬০) কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার কোনো সুযোগ ইসলাম কাউকে দেয় না। আল্লাহ বলেন, 'ওয়া ইয়ানহা আনিল ফাহশায়ি ওয়াল মুনকারি ওয়াল বাগয়ি' অর্থাৎ_'আল্লাহ নিষেধ করেন অশ্লীল কথা বলতে, অসংগত কাজ ও বিদ্রোহ করতে।' ইসলাম ন্যায়বিচারের মানদণ্ডকে সমুন্নত করতে আদেশ দিয়েছে এবং কারো প্রতি অবিচার করতে নিষেধ করে। আসলে বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সুরাহা করার ব্যবস্থা করা হলে কোনো অপশক্তি বিশৃংখলা সৃষ্টি করার সুযোগ পায় না।গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা যারা করছেন, তা অমূলক নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে চিহ্নিত যে মহল ঠেলে দিতে চাচ্ছে, এদের অপতৎপরতা রুখতে হবে।যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে গড়ে ওঠা প্রজন্ম চত্বরে তারুণ্যের বান ডেকেছে। প্রথম দিকে ব্লগার আর ফেইসবুক বন্ধুরা এ আন্দোলন শুরু করলেও যৌবনের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দলীয় খোলস ছেড়ে স্বাধীনতার পক্ষের সব শুভ শক্তি একাত্তরের চেতনা নিয়ে যুক্ত হয়ে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেছে। এই গণজাগরণ ও গণ-আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বাংলাদেশে। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনে দেশের সমগ্র শান্তিকামী মানুষের সমর্থন রয়েছে। ইসলাম গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনকে শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণের জন্য সমর্থন করে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ উচ্ছেদ করে শান্তি স্থাপনের শিক্ষা ইসলামই প্রদান করেছে। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিকারী জঙ্গি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আজ তরুণ প্রজন্মকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। শান্তির ধর্ম ইসলাম শুভ ও কল্যাণমণ্ডিত যেকোনো মানবকল্যাণপ্রদ শান্তিময় আন্দোলন কর্মসূচি প্রতি সমর্থন জানাতে তার অনুসারীদের নির্দেশ প্রদান করেছে। অশুভ শক্তিকে রুখতে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তা আরো ত্বরান্বিত ও বেগবান হোক। প্রবল আন্দোলনের উত্তাল ঢেউয়ে মানবতার শত্রু মওদুদী জামায়াত-শিবির চক্র তলিয়ে যাক এবং নিশ্চিহ্ন হোক_এটাই শুভশক্তির প্রত্যাশা। বাংলার পলি মাটিতে স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গি সন্ত্রাসবাদের স্থান হতে পারে না।

লেখক : আমীর মাহমুদ ভূঁইয়া, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
protapanws@yahoo.com

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ইসলাম সমর্থন করে না

ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই এই ধর্মের লক্ষ্য। ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচারের মাধ্যমেই সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও জঙ্গিমুক্ত একটি সুন্দর পৃথিবী চায়। ইসলামে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) কখনও একজন মানুষকে গুপ্তহত্যা করেননি। মহানবী (সা.) যুদ্ধের সময় আগে অস্ত্র উত্তোলন করতে ও অস্ত্রের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতে নিষেধ করতেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হল মানুষের জীবনকে ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে দুর্বিষহ করে তোলা এবং চরমপন্থা, বাড়াবাড়ি, জোরজবরদস্তি ও বল প্রয়োগ করে কোনো মতবাদ চাপিয়ে দেওয়া। সমাজে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, অনিরাপত্তা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা। মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা। ইসলাম ধর্মে তো মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ইসলামের নবীর আগমনই হয়েছে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পথনির্দেশনা দানের জন্য; অমানবিকতাকে পায়ে দলে মানবিক সমাজ ব্যবস্থা উপহার দেওয়ার জন্য। পবিত্র কুরআন পাকে ঘোষিত হয়েছে- ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা মায়িদা: ৩২) উক্ত আয়াতে কারিমা থেকে বোঝা গেল যে এসব ঘৃণ্যতম কাজ ইসলাম মোটেই সমর্থন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব ঘৃণিত কাজ বরাবরই শাস্তিযোগ্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলেই নিরুত্সাহিত করেছে।
নিরপরাধ মানুষকে খুন করে, পৃথিবীতে আতঙ্ক ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা কল্পিত ও মনগড়া অপকর্ম ছাড়া কিছুই নয়। যদি ইসলামের নামে কেউ এরূপ মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করে তাহলে তার সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। ইসলামের অভ্যুদয় থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত যত বছরের ইতিহাস রচিত হয়েছে ইসলামের মূল প্রচার ও প্রসারের কোনো আন্দোলন অসি শক্তি ও পেশি শক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়নি—বরং ইসলামের আদর্শিক মহানুভবতা, ক্ষমা, উদারতা, নৈতিক শক্তি ও পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। পৃথিবীব্যাপী ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে তার সুমহান মহানুভবতার মধ্য দিয়ে। যে সত্যিকার মুসলমান তার চরিত্রমাধুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে ভিন্নধর্মী মানুষ তার হাতে হাত রেখে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করছে, যে মুসলমান অন্যের নিরাপত্তার জিম্মাদার হওয়ার কথা সে কখনও কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে না। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মে জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি ও আত্মঘাতী হামলা সর্বাপেক্ষা বড় অপরাধ। হাদিস শরিফে রহমাতুল্লিল আলামিন ইরশাদ করেন ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়া অপেক্ষা আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হল মানুষ হত্যা করা।’
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের অকল্যাণে বিবেকবান মানুষ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে না। মানবতা বিবর্জিত, মায়া-মমতাহীন, দিকভ্রান্ত, জ্ঞানশূন্য মানুষ অসভ্য সমাজের কাজ করে থাকে। যারা এসব কাজে লিপ্ত হয় তারা শান্তিকামী মানুষের শত্রু, মানবতার দুশমন। তাদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের জাতীয় ও ধর্মীয় পরিচয় নেই। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা নিরপরাধ মানুষ হত্যার মহাপাপ সম্পর্কে জানে না। তারা যদি তা জানত তাহলে তারা নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারত না। পবিত্র কুরআনে কারিমে আল্লাহ বলেন ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করো না। আর যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি তার উত্তরাধিকারীকে ক্ষমতা দান করি। অতএব সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয়ই সে সাহায্যপ্রাপ্ত। (সূরা বনী ইসরাঈল : ৩৩)
মহান আল্লাহ মুসলমানদের মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মধ্যমপন্থা, ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ মুসলমানদের চরিত্রের বিশেষ দিক। তাই চরমপন্থা, ফেতনা-ফাসাদ, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই ইসলাম সমর্থন করে না। এগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস-বিপর্যয়-অশান্তি সুস্পষ্ট ইসলাম পরিপন্থী। কারণ পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশনা রয়েছে, যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘তোমরা এমন ফিতনা বা সন্ত্রাসকে ভয় করো, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা জালিম শুধু তাদেরই ক্লিষ্ট করবে না এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ সন্ত্রাসীদের লক্ষ করে আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র ইরশাদ করেন, : ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত সত্ কর্মশীলদের অতি নিকটে। তাই তোমরা তাঁকে ডাক ভীত ও প্রত্যাশী হয়ে।’
সন্ত্রাস ও বিপর্যয়মুক্ত পরিবেশ এবং শান্তি ও সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার তাগিদে সরকারে দোআলম (সা.) বলেছেন, ‘সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম, যার জিহ্বা ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্যরা নিরাপদ থাকে।’
যারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যুব সমাজ ও সাধারণকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে দেশের আলেম সমাজ, ধর্মীয় নেতা, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও খতিবসহ সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ও বলিষ্ঠ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আমরা শান্তিকামী মুসলমান। সুতরাং আমাদের জীবনে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মতো শান্তি ও মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রসার লাভ করুক, তা আমরা কেউ কামনা করতে পারি না। আমরা কোনো গোষ্ঠীকে এরূপ অকল্যাণ ও বিপর্যয় বিস্তার করার সুযোগ করে দিতে পারি না। তাই আসুন, আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বোমাবাজদের নির্মূল করার লক্ষ্যে আল্লাহর মনোনীত মানবতা ও কল্যাণের ধর্ম ইসলামের পরম শান্তি ও সাম্যের বাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে দিই।

লেখক : মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন, সহকারী সম্পাদক, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন

Why is there such an explosion of violence across the Middle East? Here's an alternative view...

What on earth has descended upon the Middle East?


Why such an epic explosion of violence? It feels strange to ask these questions of Dr Bouthaina Shaaban, one of President Bashar al-Assad’s close advisers and former translator to his father, Hafez. Her office is spotless, flowers on the table, her female secretary preparing a morning round-up of the world’s press on the Middle East, the coffee hot and sweet. At one point, when she spoke of the destruction in Syria and the mass attacks on the region’s Arab armies, it was difficult to believe that this was Damascus and that a few hundred miles to the east Isis have been cutting the throats of their hostages. Indeed, Shaaban finds it difficult even to define what Isis really is.

Not so with America and the war in Syria. “Right from the beginning of this crisis, I never truly felt that the issue was about President Assad,” she says. “It was about the weakening and destruction of Syria. There has been so much destruction – of hospitals, schools, factories, government institutions, you name it. I think the Americans take their battles against leaders and presidents – but only as a pretext to destroy countries. Saddam was not the real target –it was Iraq. And it’s the same for Libya now – America told everyone it was about Gaddafi. The real issue is about weakening the Arab armies, whoever they are. When the Americans invaded Iraq, what was the first thing they did? They dissolved the Iraqi army.”

Shaaban, of course, reflects Syria’s regime. Thus she calls the war a “crisis” and does not choose to reflect on the regime’s responsibility for this – or the numbers killed by the regime forces as well as by the rebels. What she does have is a very clear analytical brain which can shape an argument into coherence however much you disagree with her. She showed this in her research through Syrian presidential and foreign-ministry archives when she was writing a remarkable book about Hafez al-Assad’s peace negotiations with the Clinton administration, in which the old “Lion of Damascus” turns out to be a lot shrewder than the world thought he was –and his betrayal by America much deeper than we suspected at the time. She talks on about the destruction of the Iraqi army, the losses in the Syrian army, the massive suicide attack against Egyptian troops in Sinai and the killing of Lebanese troops in the Lebanese city of Tripoli. And you have to listen.

“Now all Arab armies are targeted – and the purpose is to change the nature of the Arab-Israeli conflict. The Arab-Israeli conflict is the crux of all that is going on in the Middle East. I am not saying these tactics will work. I am saying ‘they’ are targeting the Arab armies. The Egyptian army is very strong. It is a logical army that is defending its country. And then it received this huge attack in Sinai. It’s my opinion that the target is to eliminate the threat that Arab armies represent for the liberation of Gaza and the West Bank and Golan and to make Israel’s occupation easier and less costly. This is a major dimension of the cause of the ‘Arab Spring’. In fact I call it an ‘Israeli Spring’.”

Of course, it’s not difficult to argue with this. Why should the West – presumably the author of these Arab military calamities – want to weaken an Egyptian army which is, by proxy (or directly) protecting Israel itself? Why would the West want the new Iraqi armies to be crushed by Isis – which Shaaban, even though she is speaking in English, naturally refers to by its Arab acronym of ‘Daesh’? Why, indeed, would the West be bombing Isis if it wished to weaken the Syrian army?

“The Americans are the major power in the world and they are weighing this power. But what is ‘Daesh’? I feel it could be the thing it is now without financial and political help from leaders. How does it sell its oil and get its money? In Syria, we are under sanctions and we cannot transfer a penny through New York. So how does ‘Daesh’ get financed in such a huge way? Let me ask you something. When Mosul fell to ‘Daesh’, the Americans did nothing. The Americans intervened only when Kurdistan was threatened – which means the US supports the partition of Iraq. So the US move against ‘Daesh’ is a political move for other objectives. It’s interesting that the Syrian people in Ain al-Arab” – this of course refers to the Syrian Kurds in the Isis-besieged town they call Kobane – “have been more successful in fighting ‘Daesh’ than the Americans.”

Shaaban looks at me sharply. There is no mention of the constant US air strikes against  Isis around the town. But she is also contemplating the darkness of that throat-cutting institution, the woman stoned to death in Idlib, the extraordinarily effective propaganda campaign which it runs. “This is propaganda made by very professional experts. There are professional media people involved. It is being ‘directed’ by professionals. And once those who are behind ‘Daesh’ achieve their goals, then they can dispense with it, take off the black clothes and become a ‘moderate’ opposition.”

Shaaban laughs. She knows this is a clever conceit – the Middle East has been littered with monstrous “terrorist” organisations– the PLO, the Muslim Brotherhood, Abu Nidal – which have either been turned into pussycats or eliminated themselves. The next line I was waiting for. “And by the way, what is this ‘moderate’ opposition which is supposed to exist here in Syria? ‘The moderate armed opposition’, they say. How can someone who is armed and puts a gun to your head be a ‘moderate’? Our army is defending our people.” I interrupt. The world would say that civilians have a right to bear arms when they are killed by the government’s forces. No reply. The people of Syria fight for their president, she says, morale is high, the destruction of their enemies – to the health and education systems and to the architectural heritage – is enormous. And so it goes on. President Bashar al-Assad, needless to say, gets a clean bill of health.

But then Shaaban turns to Saudi Arabia, the “Takfirist”curricula in Saudi schools, the culture of head-chopping criminals in Saudi Arabia, its support for the Taliban. “It is a culture very similar to the ‘culture’ of ‘Daesh’. So why was ‘Daesh’ created?” But as an Arab nationalist, does Shaaban want to restore the old Sykes-Picot colonial border between Syria and Iraq which Isis symbolically destroyed?

“I hope the new generation of Arab nationalists will break these borders and help to create a new Arab identity, the emergence of a different reality, to be a real player in international politics. I hope young Arabs will not cling to these borders. Why should Lebanese and Syrians have to stop at their border when the terrorists can move freely across? As Arabs, we should sit down and think how we can face these challenges together. There is a master-plan, a ‘maestro’ – yes, I know people say that this is a ‘conspiracy theory’. But what I’m saying is that the the conspiracy is no longer a ‘theory’ – it is a reality we must confront together.”

This was a bit like the end of a long symphony concert, the rousing send-off as Arab nationalism is reborn. Surely that is what the original Syrian Ba’ath party was supposed to be about. Shaaban condemned Turkey for its “lies” and President Erdogan’s desire for another “Ottoman military hegemony” in the Middle East. She takes comfort from the ease with which Sunni refugees from Idlib and Aleppo have settled among Alawites and Christians around Lattaki and Tartous – although she at no point names these religious groups. And she talks about the vast number of families who have lost loved ones – no blame attaching to anyone at this point – but then she utters an irrefutable truth. “When you kill a member of a family, you kill the whole family.” And there really is no answer to that one.

© Robert Fisk

The ‘flowers’ of the Arab Spring are so distracting that Ariel Sharon’s death has barely raised a whimper

For years, Iraqis have been telling me that they prefer ‘security’ to ‘anarchy’

Has ever the Arab awakening – the Arab “Spring” if we were to believe the nonsense spouted at the time – looked more desperate, more bloody, more hopeless, more despairing than it does today? I am not referring to the anguish so distracting the Arab world that it scarcely raised a whimper this weekend when the man most of them regarded as a war criminal – Ariel Sharon – was mourned by the West and its frightened journos as “iconic”, “legendary”, “audacious”, a “bulldozer” and “a proudly Zionist general”.

Incredibly, the presenter of Al Jazeera English even offered her “sincere condolences” to an Israeli friend of this dreadful man. When the Israeli Kahan Commission report was quoted by reporters, they inaccurately said it held Sharon only “indirectly” responsible for the 1982 Sabra and Chatila massacres of up to 1,700 Palestinian civilians murdered by Israel’s proxy Lebanese militia. In fact, the official text also states that Sharon was “personally” responsible.

But why should Arabs care about the final demise of a man who, like much of the Arab world, spent the last years of his existence in a coma? For the awful truth – and it has to be stated at last – is that the Arab revolutions have brought about unspeakable slaughter, an unprecedented flood of refugees and economic disaster. As a newspaper seller put it simply to me in Cairo a few weeks ago, “the revolution was great, what followed was terrible”. Indeed, across the Middle East, millions of Arabs, I suspect, now believe that the overthrow of their dictators was a tragedy, that if dictatorship meant political and physical imprisonment, then freedom brought only bloodshed, lawlessness, insecurity and a craving for the old autocrats.

A lot of Arabs, let us speak frankly, desire a return to good old homely police states with plenty of corruption and torture to ease the springs, rather than the brave new world that the West supposedly wanted them to enjoy – and which they deserved to enjoy for themselves. For years, Iraqis have been telling me that they preferred a state of “security” to a state of “anarchy”. My Baghdad driver used to complain to me that if he was riding a bus during Saddam’s rule, he knew what he could and couldn’t say – but that now he could say nothing since he didn’t know the views of the passenger sitting next to him. I tried to argue him out of this view, on the grounds that he would live in perpetual slavery if he did not open his mouth. I failed to convince him.

This weekend, I asked that long-standing, brave nihilist Walid Jumblatt, the leader of Lebanon’s minuscule Druze community and one of Bashar al-Assad’s most constant critics, if he agreed with me. He condemned “the willingness of some people to have police states like before”. And Jumblatt, never one to miss a floral parallel to the iniquities of the region, referred to a “spring” which “had blossomed a variety of unique ‘flowers’ like Isis, Jabhat al-Nusra and so many other exotic varieties. Thanks to climate change, we have remarkable new cactuses, like Maliki and Sisi, plus a new brand of exquisite truffles, with a delicious flavour, newly catalogued as Ghannushi and Morsi.”

Jumblatt’s contempt for all their houses – for the Islamists fighting Bashar in Syria, for the pseudo-dictators Nouri al-Maliki and Abdul Fattah al-Sisi of Iraq and Egypt, for the “elected” Islamist leaders Mohamed Morsi of Egypt and Rashid al-Ghannushi of Tunisia – was in keeping with his scorn for the Syrian President, “expert in ‘botany’ … obliged to safeguard these unique blossoms with some needed ingredients, home-made chemicals blended with phosphorous”.

True to form, Jumblatt ended with a crashing coda for me. “I promise you, Robert, that my next move is to put a wreath of flowers on the tombstone of Lawrence [of Arabia], pay respect to the memory of Peter O’Toole, praise highly Mr Sykes and Mr Picot.” I do not need to explain these characters or this cynicism to you, O reader. “As for Lord Balfour,” Jumblatt concluded, “well, I think he should be very happy with this Arab Spring.”

Probably. Because while Israel buries its Zionist hero, the Arabs who overthrew their own leaders are either fighting each other – to the dismay of their erstwhile American, British and French supporters – or are praying for the return of the “democratic strongman” so fervently sought after by the likes of Daniel Pipes and his fellow neo-conservatives in the US. In the Middle East, the armies are winning, the little men are in hiding or – as in Syria or Egypt – being shot down in the streets or – most shamefully of all – demanding an end to all the liberties they won.

And those famous “Arab masses” who sought dignity and freedom? I do not believe they have run away. The victories of 2011 are there to haunt the autocrats, new and old. But the Palestinians are forgotten. And Jumblatt is right. Lord Balfour should be happy with the “Arab Spring”. Now he’ll have time to chat about it all with Sharon. If they’re in the same place.

Abe’s shame – and that of Britain
The Japanese Prime Minister, Shinzo Abe, has yet again outraged the Chinese by trooping to the memorial shrine of Japan’s war criminals. I’ve been there – it even contains an old Japanese steam train that travelled on the Burma railway.

A cousin of mine – the son of my Dad’s sister Freda, Royal Marine Jim Feather – died building it. Shame on Abe. But Independent reader Arthur Stockwin, stirred by my report of a wartime American journalist’s attempt to tell the difference between Japanese and Chinese racial stock, has sent me an extraordinary quotation from a Chatham House publication, World Today, published in August 1945. Shame is not the word for it.

Signed “TL” and entitled “The Japanese Character”, it says that the Japanese “are of mixed racial origin, a combination of an early Caucasoid stock from north and east Asia, a Mongolian and a Malayan strain … it is the presence of that Malayan blood which is the cause of that intensely exuberant and unbalanced emotionalism so characteristic of the people.”

If that’s not enough, Chatham House informed its academic readers that “the preponderance of … the Malayan and Mongolian [elements] is evidenced in the two distinct types still to be observed in Japan – the aristocratic type representative of the former, the long thin face, the slightly aquiline and narrow nose…” As for “the pudding-face peasant with sunken nose, wide nostrils, high cheek-bones, thick lip and protruding teeth,” these are a Japanese “relic of the Mongolian influx”.

I wonder what Abe thinks about that. Come to think of it, it’s pretty much the same kind of racist stuff the English once used about the Irish.

© ROBERT FISK

Syrian rebels have taken iconoclasm to new depths, with shrines, statues and even a tree destroyed – but to what end?


Eccentricity marks the path to heaven or hell. Take the Takfiri rebels trying to overthrow Bashar al-Assad’s regime in Syria. They have chopped off the heads of their enemies, eaten a few human entrails, massacred Christians and Alawites – the Damascus government, of course, has done its share of civilian bloodletting and war crimes – and even gone to war on the Kurds. But of all the activities of the al-Qa’ida/al-Nusra/Islamic State of Iraq and Greater Syria insurgents in Syria, surely the weirdest has been an iconoclasm worthy of both Henry VIII and the Taliban: the destruction of shrines, tombs and the statues of poets and caliphs.
Take, for example, Abu Tammam Habib ibn Aws who was born near Damascus AD804. He was assistant to a weaver and the son of Christian parents – an obvious provocation to the Nusra lads 2,213 years later – but travelled to Egypt to study poetry. He went to Armenia and Iran, and produced an anthology of other poets’ work known as the Hamasah, an anthology of bravery, courage in defeat and revenge.

A work, you might think, that could appeal to the Salafists anxious to rid Syria of its infidel president. But no. In his native town of Jasim in the countryside of Deraa this year, the Islamists destroyed his statue. They simply blew it up with explosives. Was it because he had Christian parents? Unlikely, surely, since some of the current followers of al-Nusra are Muslim converts. Or was it because Abu Tammam brazenly compared the composition of poetry to the sex act? May he be turned to dust!

So let’s move on to Abu al-Ala Ahmad ibn Abd Allah al-Ma’arri, who was born almost 170 years after Abu Tammam near Aleppo, the ancient city currently split between rebel and government fighters.

Like Milton, al-Ma’arri was almost blind, but produced a popular collection of poetry called The Tinder Spark and later, in Baghdad – where he was adored by writers but lived in almost hermit-like isolation on a vegetarian diet – wrote Unnecessary Necessity, which complained about the rhyming scheme of poetry. More dodgy, however, al-Ma’arri also described a Dante-like visit to heathen poets in paradise. And a later work was described as a parody of the Koran. He believed, so we are told, in “social justice” – whatever that was in the 9th century – but thought a world without children would spare future generations the pain of life.

Well, you can understand why the al-Nusra boys scratched their heads when they saw al-Ma’arri’s turbaned statue. For the poor chap is also credited with telling his readers: “Do not suppose the statements of the prophets to be true… The sacred books are only such a set of idle tales as any age could have…” So off with his head! The al-Nusra guys decapitated the statue in al-Ma’arri’s home town of Maarat al-Numan.

Then we come to Harun ar-Rashid himself, the fifth Abbasid caliph of One Thousand and One Nights fame, who ruled Islam’s greatest empire, putting down revolts – Assad-style – in Syria, Egypt and Yemen, even bringing Tunisia under his rule. He became an immensely wealthy man whose wife insisted that only gold and silver would hold food on the family table. The palace was packed with singing girls, concubines and servant girls. But… word had it that he maintained a homosexual relationship with Jafar, one of his principal administrators, who was later executed. Luxury, concubines, vice. No chance, then, for Harun’s statue in the city of Rakaa – the only town in Syria currently under total Islamist control. His image, in the city’s Ar-Rashid Park, no less, was destroyed.



Need one go on? The shrine of the Prophet’s companion Hujr ibn Adi has been destroyed in Rif Damascus (the countryside around the capital) and a shrine to a Sufi sheikh in Busaira has been blown up. The Islamists have even announced the cutting down of a 150-year-old tree in the town of Atmeh – next to another shrine which the Salafists had taken over. “Thank God Almighty, the tree… has been removed, after people were worshipping it instead of God,” an Islamist informed a French news agency.

But what’s new? Didn’t the Taliban destroy the Buddhas of Bamiyan, just as the Saudis have reduced every old building in Mecca to rubble and the Islamists hundreds of shrines in Pakistan? Not to mention the destruction in Timbuktu. Think Henry VIII. Think Oliver Cromwell – who would surely have understood the cruelty of the Syrian war. And beware graven images. Pity about the tree.

More from Robert Fisk this week here: http://www.independent.co.uk/voices/comment/do-you-get-phonecalls-from-nowhere-9021026.html