Friday, 20 March 2015

চলমান অচলাবস্থার অবসানে সরকারের ভূমিকাই মুখ্য

একটি বিভাজিত জনগোষ্ঠী ও তাদের আবাসভূমিকে সার্থক জাতি রাষ্ট্রের অবয়ব দিতে এবং একটি অভিন্ন লক্ষ্যে পরিচালিত করতে একজন বিসমার্ক, দ্যগল বা বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাবের অপেক্ষা করতে হয়। হাজার বছরের লালিত এমন স্বপ্ন পূরণে এ দেশে বঙ্গবন্ধু সেই প্রচেষ্টায়ই হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ট্র্যাজিক অকাল তিরোধানের পর এক কালের ঈর্ষণীয় সময় প্রকৃতির বাংলাদেশ আজ বহুধা বিভক্ত। দেশের বিভক্তি আজ রাজনৈতিক অঙ্গনকেও প্রকটভাবে কলুষিত করে ফেলেছে বিভিন্ন মহলের শক্তির সহিংস মহড়ায়। যেখানে শান্তির ললিতবাণী, সংলাপের সনির্বন্ধ আবেদন, আপস-মীমাংসা-নিষ্পত্তির বহুমুখী উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা রাজনৈতিক গোয়াতুমির কাছে হার মেনেছে শুধুমাত্র ক্রিকেটের একটি ঐতিহাসিক বিজয় দলমত নির্বিশেষে সমগ্র জাতিকে যে নির্মল আনন্দের একটি ধারায় অবগাহন করাতে পেরেছে তা কম কথা নয়। আমরা যদি আরো বেশি করে এই অভিন্ন আনন্দের সূত্রেও কোনো অলৌকিক ইন্দ্রজালের প্রভাবে গ্রন্থিত হতে পারতাম, কতই না ভালো হতো এই দারিদ্র্য ও বৈষম্যপীড়িত দুঃখিনি বাংলাদেশ ও তার ততোধিক দুঃখী মানুষের জন্য।
অস্ট্রেলিয়ার এডিলেডে বাংলাদেশের বিজয় সংবাদে সারাদেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দে ফেটে পড়েছে, যা জাতির বিভাজনের বাঁধকে মুহূর্তের জন্য হলেও ভেঙে একাকার করে দিয়েছে। কিন্তু এই আনন্দ উদযাপনেও বিপত্তি। সরকারি দল বিশাল আনন্দ মিছিল করেছে, কেউ বাদ সাধেনি। কিন্তু বিএনপির আনন্দ মিছিল বিভিন্ন স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, দলের একজন অতি উৎসাহী কর্মী বিএনপি কার্যালয়ের সামনে ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়ে ব্যানার টাঙাতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছে বলে সংবাদপত্রে জেনেছি। কী ভয়ানক হীনম্মন্যতা!
আন্তঃদলীয় বিভেদ, রেষারেষি এবং জেদাজেদির ষোলোকলা কি এখনো পূর্ণ হয়নি? সরকার ইতোমধ্যেই বিএনপির জন্য দেশে-বিদেশে এক জঙ্গি বা সন্ত্রাসী সংগঠনের লেবেল সেঁটে দিয়ে হয়তো আশা করছে যে একজন অবরুদ্ধ বিএনপি নেত্রী আরো কিছুদিন হাত-পা ছুড়ে এক সময়ে ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে চলমান আন্দোলনের হাল ছাড়বেন। অন্তত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুগ্রহ প্রত্যাশী পরিষদ দল তাকে এমনই আশ্বাস ও পরামর্শ দিয়ে থাকবে। কিন্তু বেগম জিয়া আহূত অবরোধ-হরতাল তৃতীয় মাসে বাড়ালেও বিএনপির হালছাড়ার কোনো আলামত নেই।
ইত্যাবসরে দেশ উঠছে লাটে। প্রথম দিকে বিএনপি আন্দোলনে জনজীবনসহ সব কিছু স্বাভাবিক আছে দাবি করলেও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কপালে বলি রেখা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। এই ভূখণ্ডের বারবার পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের শক্তি প্রবাদতুল্য। কিন্তু একটি প্রলম্বিত অচলাবস্থা এবং অস্বাভাবিকতায় যদি জাতি-সত্তার ভিত একবার ক্ষয়ে যায়, জাতির ওই মৌলিক উপাদান ছাড়া জাতিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না যেমনটি আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইয়েমেন বা সোমালিয়ায় হয়েছে। আমাদের সবারই পবিত্র দায়িত্ব দেশ ও জাতিকে ওই অবস্থায় ঠেলে না দেয়া।
সরকারের ক্ষমতা লাভের প্রক্রিয়া যতই প্রশ্নবিদ্ধ হোক যতক্ষণ কর্তৃত্ব আছে, সরকার সরকারই। দেশের সব ভালোমন্দের জবাবদিহিতা তারই। চলমান সংকটের যেভাবেই অবসানের কথা ভাবা থাকে সব কিছুতেই কিন্তু সরকারেরই মুখ্য ভূমিকা। কেউ কিছু করতে পারবে না যতক্ষণ না সরকারের তরফ থেকে সবুজ সংকেত আসে। তার প্রমাণ একাধিক মহল ও গোষ্ঠী থেকে এ যাবত আসা সংলাপ সমাধানের উদ্যোগে ব্যর্থতা।
সব দল ও সংগঠনে লুকিয়ে থাকা স্বার্থন্বেষী অপরাধীচক্র এবং সুযোগসন্ধানীরা এমনই অচলাবস্থা, প্রশাসনে স্থবিরতা এবং চলমান পরিস্থিতির অস্পষ্টতা চায়। সরকার যখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় টালমাটাল এবং আমলানির্ভর তেমনই অস্বচ্ছ ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার তাদের জন্য সহজ হয়। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন দেশব্যাপী দুশ্চিন্তার কালোছায়া তখন টেন্ডার নিয়ে খোদ সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে গোলাগুলি হয়। জাতীয় নির্বাচনের ইস্যু ঝুলিয়ে রেখেই ডিসিসি নির্বাচনের দৃষ্টি ফেরানোর মহড়া কি রাজনৈতিক সংকট নিরসনে কোনো অবদান রাখবে? একটাই দৃশ্যমান অবদান হলো জমজমাট মনোনয়নবাণিজ্য বা ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের পকেট ভারী করবে।
অর্থবছরের সমাপ্তি যতই নিকটে আসছে উন্নয়নে বাজেটের তড়িঘড়ি ব্যবহারে বরাদ্দ অর্থের প্রায় সবটাই নজরদারি ও তত্ত্বাবধানের অভাবে কার্যত লোপাট হচ্ছে। ভেঙে পড়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে মাত্র দু’মাসের অবরোধে দেশ চল্লিশ বছর পেছনে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামো ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকিং খাতে চলছে প্রভাবশালীদের অবাধ লুটপাট। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও গুটিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের গর্ব গার্মেন্টস শিল্পের রফতানি প্রক্রিয়া অবরোধে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ক্রেতারা তৈরি পোশাকের বিকল্প উৎস খুঁজছেন। অচলাবস্থা আরো দীর্ঘায়িত হলে নতুন জট সৃৃষ্টি হবে। প্রতিবন্ধকতা হবে অনতিক্রম্য সাধ্যের সীমানা ছাড়িয়ে যাবে সংকট। নানা অপশক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে দেশব্যাপী যা সামাল দেয়া সাধ্যাতীত হবে সরকারের জন্য। তাই এখনই সময় সরকারের জন্য সংকট নিরসনের। তার জন্য প্রথম পদক্ষেপই হবে উভয় নেত্রীর মুখোমুখি হওয়া। বিএনপি নেত্রী নাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য উš§ুখ হয়ে আছেন। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর আপত্তি কোথায় বা কিসের? তার মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ার বা বিএনপি নেত্রীর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের শর্ত মেনে নেয়ার ভয়? দেশ ও জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের খাতিরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তেমন ভয়কে জয় করার সাহস ও দেশপ্রেম অবশ্যই ধারণ করেন।
তাছাড়া মুখোমুখি হলেই তো মর্যাদা ক্ষুণœ হয় না, প্রধানমন্ত্রিত্বও যায় না। শুধু অর্থবহ আলোচনার দরজা খোলে এবং সংকট থেকে নিষ্ক্রমণের পথ উšে§াচিত হয়। মুখোমুখিই যদি না হলাম বা কথাই যদি না বললাম, তাহলে তো রোষানলে পুড়তে হবে আমাদের । আমরা নগণ্য নিবন্ধকাররা এর বেশি কিছু বলবার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করতে পারি না। শ্রেণীগত ও মতাদর্শগতভাবে বিএনপি অবশ্য সন্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদী দল নয়। যদি বারবার তেমন অপবাদ দলটিকে দিয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় বিএনপিকে জঙ্গিবাদের লেবেল সেঁটে দেয়া হয়, তা হবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি হবে আরেক আঘাত। তার চাইতে বরং গণতান্ত্রিক আচরণ দিয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক সংগঠনকে একটি গণতান্ত্রিক পরিসরে ঠাঁই প্রদান হবে ক্ষমতাসীনদের দেশ প্রেমের পরাকাষ্ঠা। আমরা পরম আশাবাদের সঙ্গে তেমনই এক বাস্তবতার প্রত্যাশায় থাকলাম।

লেখক: এম আবদুল হাফিজসাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস, কলামিস্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা
www.manobkantha.com/2015/03/18/20468.php#sthash.qbKPZYWd.dpuf