মানবজাতির অতীত ইতিহাসজুড়ে যেমন ছড়িয়ে আছে ভেদাভেদতাড়িত এমন অনেক কলঙ্কের ইতিহাস, তেমনি আছে মানুষের মাথা উঁচু করা অনেক উজ্জ্বল অর্জন। বলতে দ্বিধা নেই, মানুষ হিসেবে যতটুকু মানমর্যাদা এবং সম্মানের আশিস আমরা আমাদের দয়াময় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে লাভ করেছি সেটাই আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। শাশ্বত ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ এক নারী থেকে। তারপর তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রেÑ যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহভীরু। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব খবর রাখেন।’ [হুজুরাত : ১৩]
অর্থাৎ সমুদয় মানুষ একজন পুরুষ ও একজন নারীর সন্তান। একই নারী-পুরুষের সন্তানদের মধ্যে যেমন মান ও রঙের কোনো ভেদাভেদ থাকতে পারে না তেমনি পৃথিবীর কোনো মানুষের সঙ্গে অপর কোনো মানুষের বর্ণ, বংশ ও মানের ভেদাভেদ থাকতে পারে না। উচু-নিচুর কোনো প্রশ্নই দাঁড়াতে পারে না এখানে। এ শুধু বংশানুক্রমিক মানব ইতিহাসেরই দাবি নয়। যে মিথ্যা অহংবোধ জন্ম দেয় বিভেদের পঙ্ক এবং বিভাজনের কলঙ্ক কত শক্ত ভাষায় তার মূলোৎপাটন করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তা। জগতের প্রতিটি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেনÑ ‘কালপ্রবাহে প্রতিটি মানুষের ওপর তো এমন একটি সময় এসেছিল যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শক্রবিন্দু থেকেÑ তাকে পরীক্ষা করার জন্য; আর এ জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছিÑ হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি শৃঙ্খল বেড়ি ও লেলিহান অগ্নিশিখা। [দাহর-৭৬:১-৪]
এটা পবিত্র কোরআনের ৭৬ নম্বর সুরা। এই সুরাটির দুটি নামÑ দাহর ও ইনসান। দাহর অর্থ কাল ও সময় আর ইসসান অর্থ মানুষ। মর্ম খুবই সরল। সামান্য পানি থেকে সৃষ্টিজগতের প্রতিটি মানুষের। ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, সাদা-কালো কোথাও এই নিয়মের ব্যত্যয় নেই। তাহলে কেন মানসম্মানে ব্যত্যয়ের হিংস্র প্রকাশ! কালপ্রবাহে প্রতিষ্ঠিত সর্বজনবিদিত মানবজীবনের এই মমতার সৃষ্টিগত রেখায় যারা সমর্পিত তারাই ‘মানুষ’। যারা সৃষ্টি ও জন্মের সুবাদে প্রাপ্ত এই শিক্ষাকে ভুলে যায়, ভুলে যায় একজন পুরুষ ও একজন নারীর বন্ধনে প্রতিষ্ঠিত বনুআদমিক সাম্যের আত্মীয়তা তারা মানুষ নয়Ñ মানুষ সমাজের কলঙ্ক! নজরুল ভালোই বলেছেন
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি!
[সঞ্চিতা : কবিতার নাম : মানুষ]
আমাদের নবীর কথা বলি! প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন : আমি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম তিনি কাবা শরিফ তাওয়াফ করছেন এবং বলছেন : এত যে শ্রেষ্ঠ তুমি আর কত যে শ্রেষ্ঠ তোমার সুবাস! কত যে মহান তুমি আর কত যে মহান তোমার সম্মান! সেই আল্লাহর শপথ যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণÑ একজন মুমিন বান্দার সম্মান আল্লাহর কাছে তোমার সম্মানের চেয়েও অধিক! তার জীবন ও সম্পদ সম্পর্কে অশুভ কিছু ভাবা যায় না।’ [আলমাকাসিদুল হাসানা, হাদিস : ১২২০]
আমরা স্মরণ করতে পারি বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণের কথাও। লক্ষাধিক সাহাবির বিশাল সমাবেশে তিনি খাপখোলা তরবারির ভাষায় বলেছেনÑ হে লোক সকল! মনে রেখো! তোমাদের সকলের প্রভু একজন এবং তোমাদের পিতাও একজন। কোনো আরবি কোনো আজমির চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। নয় কোনো আজমি কোনো আজমি কোনো আরবির চাইতে শ্রেষ্ঠতর কোনো সাদা কোনো কালোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়; নয় কোনো কালো কোনো সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ! তবে তাকওয়া ও আল্লাহভীরুতার বিাচরে... [মানবতার নবী : ৩৪]
কোনো সাদা কোনো কালোর চাইতে শ্রেষ্ঠ নয় এমন বাণী হয়তো আরও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে! হয়তো পাওয়া যাবে কালো মানুষের পক্ষে বয়িত দীঘল দীঘল কবিতা এবং দার্শনিক অনেক রচনাও। কিন্তু সত্যিকার অর্থে সাদা-কালোর ভেদাভেদ ভেঙে সমাজজীবনে কালোকে সাদার সঙ্গে সমান গৌরবে সমান সম্মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংস্কৃতি নির্মাণে ইসলাম ও ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অবদান রেখেছেন তা সভ্যতার ইতিহাসে এক অবাককরা বাতিঘর! ধর্মদর্শন আর যাপিত জীবনের এমন মিল হয়তো আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি যেখানেই মুসলমানের বাস সেখানেই বাজিয়ে দেখা যেতে পারে, আমাদের এই দাবি কতটা সত্য। এখনো প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ কাবার প্রাঙ্গণে সমবেত হয় ওমরা করতে। ছুটে যায় পাক মদিনায় নবীজির কবর জিয়ারত করতে। সাদা-কালো আর আরব আজম কী যে আন্তরিকতায় মিশে যায় পথের বাঁকে বাঁকে! গভীর উষ্ণতায় করমর্দন করছে! পরস্পরে আলিঙ্গনে মিলিত হচ্ছে। হয়তো জীবনে এই প্রশ্ন সাক্ষাৎ। কিন্তু উদ্ভাসিত হাসি যে কথা অনুমান করতেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরচেয়ে বড় কথাÑ মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ ইবাদত নামাজে পৃথিবীজুড়ে কত যে কালো সাদাদের ইমাম হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে তার কোনো হিসাব কষা যাবে?
এই বেলাল রা.-এর কথাই বলি! পৃথিবী একশ সত্তর কোটি মুসলমান যতটা সম্মান ও গৗরবের সঙ্গে স্মরণ করে হজরত আবু বকর সিদ্দিক, হজরত ওমর ফারুক, হজরত উসমান ও হজরত আলী রা.কে ঠিক ততটা আবেগ ও সম্মানেই স্মরণ করে হজরত বেলাল রা.কে। অথচ তিনি ছিলেন একজন হাবশি কৃষ্ণবর্ণ ক্রীতদাস! সমকালীন অর্ধেক পৃথিবীর শাসক হজরত ওমর রা. যখনই হজরত আবু বকর রা.-কে স্মরণ করতেন, স্মরণ করতেন হজরত বেলাল রা.-কেও। বলতেনÑ ‘আবু বকর আমাদের নেতা আর তিনি আজাদ করেছেন আমাদের নেতা বেলালকে।’ অথচ কেউ যখন নানা কৃতকর্মের কথা বলে মুখের ওপর প্রশংসা করত হজরত বেলাল বিনয়ের সঙ্গে মাথানত করে উত্তর দিতেনÑ ‘আমি তো একজন কৃষ্ণবর্ণ হাবশি... গতকালও এক ব্যক্তির ক্রীতদাস ছিলাম!
আমাদের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম ঘটনা মক্কা বিজয়। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আর সম্মানিত সঙ্গীগণকে শুধু এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সমর্পণের ‘অপরাধে’ আপন জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। মাত্র আট বছরের ব্যবধানে যখন ফিরে আসেন প্রিয় মক্কায় মহান বিজয়ীর বেশে তখন পুরো মক্কাকে আন্দোলিত করে কাবা শরিফের ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আজান দিয়েছিলেন হজরত বেলাল রা.! অতঃপর বিজিত মক্কাবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে আমাদের নবীজি বলেছিলেনÑ ‘হে কুরায়েশ সম্প্রদায়! আল্লাহতাআলা তোমাদের মূর্খতার যুগের অহঙ্কারকে চূর্ণ করে দিয়েছেন; চূর্ণ করে দিয়েছেন বাপ-দাদাদের নামের দাম্ভিকতাকে! শোন, সকল মানুষ এক আদমের সন্তান আর আদম ছিলেন মাটির তৈরি। [রিজালুন হাওলার রাসুল : ১০৪]
রঙ নয়Ñ গুণ ও চরিত্রের মাপে মানুষকে গ্রহণ করার এই যে শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন আজও শিক্ষার সেই সরল রেখা থেকে একপা বিচ্যুত হয়নি মুসলিম উম্মাহ। শুভ্র ও ক্রীমবর্ণ পোশাকে চিকচিকে কালো কিশোরদের প্রাণময় উপস্থিতি যারা অন্তত একবার মক্কা শরিফ কিংবা মদিনা শরিফে দেখেছেনÑ শীতল করা কাজলবরণ সেই ছবি সেকি জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবে? এক কথায় বর্ণবৈষম্যের কলঙ্ক বিনাশে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অবদান রেখে গেছেন মানব ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই।
বিশেষ করে তাকে মনে পড়ে তখন যখন এই একুশ শতকের বিদ্বান পৃথিবীতে বসে পড়তে হয় পত্রিকার শিরোনামÑ ‘কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে শ্বাসরোধে হত্যা’ খালাস আরেক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ।’ ঘটনা আমাদের মতো কোনো গরিব কিংবা শিক্ষাবঞ্চিত কোনো আফ্রিকান দেশের নয়। সরাসরি শিক্ষা ও সভ্যতার পীঠস্থান আমেরিকার। পত্রিকার ভাষায়Ñ যুক্তরাষ্ট্রে এবার আরও এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি হত্যার দায়ে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন নিউইয়র্কের স্ট্যাটেন আইসল্যান্ড আদালতের একটি গ্যান্ড জুরি। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় অনুযায়ী বুধবার (৩.১২.১৪) গ্র্যান্ড জুরি (মামলা চালানোর জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়নকারী বিচারকদের বোর্ড) এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই দেশটির বেশ কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে অবশেষে মার্টিন অ্যাটর্নি জেনারেল এরিক হোল্ডার জানান, কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয়ভাবে তদন্তের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এই হলো আমাদের উদার আমেরিকা! এখানে আমরা এও স্মরণ করছিÑ ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের আদেশÑ ‘সকল আফ্রিকানকে তাদের সঙ্গে পরিচিত বই রাখতে হবেÑ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে ২১ মার্চ সে দেশের শার্পভিলে সমবেত বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ৬৯ ব্যক্তি নিহত ও ১৮০ জন আহত হয়। অবশেষে ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৬০ সালের শার্পভিল ঘটনার স্মরণে ২১ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিকে বর্ণবৈষম্য বিলোপের আন্দোলন দ্বিগুণ তীব্র করার জন্য বিশ্ব সমাজকে অনুরোধ জানায়। সেই থেকে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত সব দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। পালিত হয়ে আসছে বাংলাদেশেও। আমরা বিশ্বাস করিÑ এই দাবি মহৎ ও মানবিক। প্রশংসিত এই আয়োজন। তবে বর্ণবৈষম্যের আগুন থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হতে হলে সমর্পিত হতে হবে পরীক্ষিত শরণালয়ে। পৃথিবীর দেড় হাজার বছরের যাপিত ইতিহাস এবং যুগযুগান্তের ধর্মদর্শনের ইতিহাস সাক্ষীÑ পৃথিবীর সব মানুষকে মর্যাদার একই চাদোয়ার নিচে যেভাবে সমবেত করতে পেরেছেন ইসলামের নবী তেমনটি আর কেউ পারেনি। তিনিই পেরেছেন স্পষ্ট করে বলতেÑ যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়। [আবু দাউদ, হাদিস : ৫১২৩] সুতরাং দল গোষ্ঠী ও বর্ণবাদের কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে বর্ণবাদের আগুন থেকে ফিরে যেতে হবে পাক মদিনায় হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে।
লেখক : মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, শিক্ষাবিদ ও কলামনিস্ট