.jpg)
বাক্য বিনিময়ের ধর্মীয় রীতিনীতি
যেসব বিষয় মানুষকে অন্যান্য প্রাণিকুল থেকে নির্বাচিত করে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করে; বাক ও বোধশক্তি এর অন্যতম। সৃষ্টিজগতের মধ্যে মানুষেরই কেবল বাকশক্তি রয়েছে। মনের ভেতরের ঘূর্ণায়মান কল্পনা-অনুভূতিকে মানুষ বাকযন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই অন্যের কাছে প্রকাশ করে। নিজের প্রয়োজনের কথা, হৃদয়ের গহিনে থাকা অনুভূতির কথা এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতও প্রকাশ করার উত্তম মাধ্যম হলো বাকযন্ত্র। ভাষার সর্বোত্তম ব্যবহারে মুহূর্তের মধ্যে কারো মন জয় করা যায়। আবার এ ভাষা দিয়েই অন্যের হৃদয়ে কম্পন ও রক্তক্ষরণ করা যায়। গালাগাল, বল্গাহীন কথাবার্তা, বাচালতা, যাচ্ছেতাই বলে যাওয়া কেবল ধর্মবিরোধীই নয়; যেকোনো সভ্যতা, আদর্শ ও সুরুচিপূর্ণ ব্যক্তির দৃষ্টিতেও নিন্দনীয়। শাশ্বত জীবনব্যবস্থা ইসলামে পারস্পরিক বাক্য বিনিময়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে।অনাবশ্যক কথাবার্তা পরিহার করা উচিত
মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা অহেতুক কম ও কথা থেকে বিরত থাকেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়ী, যারা অসার ক্রিয়াকলাপ বা অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে।' (সুরা : মুমিনুন, আয়াত ১-৩)। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 'ব্যক্তির জীবনে ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় তার অহেতুক কথা ও কর্ম ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে।'
মূলত সাবলীল, প্রাঞ্জল কথাবার্তা আভিজাত্যের পরিচায়ক। উত্তম কথায় মানব মর্যাদা উন্নত হয়। ব্যক্তিত্বের স্তরও নির্ধারিত হয় এ কথার মাধ্যমে। যদিও কখনো কখনো এ কথাই বহু বিপদ টেনে আনে, মানব মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, নিজের জীবন-জীবিকার মাধ্যমগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই ইসলামে বাক সংযমের কথা বলা হয়েছে। 'মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা সংরক্ষণের জন্য তার নিকটেই তৎপর প্রহরী রয়েছে।' (সুরা ক্বফ, আয়াত ১৮)।
ভিন্নমতাদর্শীদের ব্যাপারে চাই সতর্ক শব্দ প্রয়োগ
ধর্ম-বর্ণ-ভাষা এবং চিন্তা ও আদর্শগত পার্থক্য আল্লাহর অসীম কুদরতের পরিচায়ক। সৃষ্টির এ বৈচিত্র্য প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও আদর্শিক ফারাক থাকলেও মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে নম্র, কোমল, শালীন ও শিষ্টাচারপূর্ণ পন্থায়। খোদাদ্রোহী ফেরআউনের কাছে যখন মুসা ও হারুন (আ.)-কে পাঠানো হয়, তখন এ বিশেষ হেদায়েত দেওয়া হয়েছিল, 'তোমরা তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।' (সুরা ত্ব-হা, আয়াত ৪৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, 'তোমরা উত্তম পন্থায় (সৌজন্যের সঙ্গে ও যুক্তিসংগতভাবে) আহলে কিতাবের সঙ্গে তর্ক করবে।' (সুরা আনকাবুত, আয়াত ৪৬)।
সম্মানিতদের অপমান করা যাবে না
বড় ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে একটি হাদিস খুবই প্রসিদ্ধ। 'যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না, সে আমার উম্মত নয়।'
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, " 'কাব্বির', 'কাব্বির'- বড়কে শ্রদ্ধা করো। বড়কে শ্রদ্ধা করো।" (বোখারি ও মুসলিম)।
অন্য হাদিসে এসেছে, 'তোমরা মানুষদের তাদের স্ব স্ব মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করো।' (আবু দাউদ)
কাউকে মন্দ নামে ভূষিত করা নিন্দনীয়
কাউকে কটাক্ষ করা, উপহাস করা, কারো দিকে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করা এবং মন্দ বিশেষণে কাউকে ভূষিত করা ইসলামে খুবই গর্হিত অপরাধ। 'তোমরা একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না; ইমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা অতি নিন্দনীয়।' (সুরা হুজুরাত, আয়াত ১১)।
মৃতদের নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি নিষিদ্ধ
সম্প্রতি আমাদের দেশে মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি, তাদের ব্যাপারে অশালীন বাক্য ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে গেছে। অথচ একাধিক হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা আছে, 'তোমরা মৃতদের গালি দিয়ো না।' অন্য হাদিসে এসেছে 'ভালো বিষয় ব্যতীত মন্দ বিষয়ে মৃতদের নিয়ে আলোচনা করো না।' মুসলিমপ্রধান এ দেশের নেতা-নেত্রীরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবেন, এমনটাই সবার কাম্য। আর তাঁদের মধ্যকার ক্রমসম্প্রসারমাণ বিরোধ নিরসনেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, শালীন আচরণ, সংযত বাক্য বিনিময় সময়ের অপরিহার্য দাবি।
লেখক : কাসেম শরীফ, গবেষক, সাংবাদিক