শ্রদ্ধেয় অগ্রজ কবি অরুণ ভূষণ দাশের ভাষায় ‘যারাই গিয়াছে জাগাতে শুধুই শোনিতে হয়েছে লাল, নিঝুম দ্বীপের লোহার গরাদ টুটেনিতো এতোকাল’। আজকের বাংলাদেশ কারো করুণায় পাওয়া নয়। আব্দুল লতিফের বিখ্যাত সেই গান ‘‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারোর দানে পাওয়া নয়, আমি দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি জানা আছে জগৎময়’। সেই লোহার গারদ ভেঙে বাঙালিকে স্বাধীনতার সূর্য এনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৫তম জš§বার্ষিকী। জাতীয় শিশু দিবসও। বঙ্গবন্ধু ১৯২০ সালের এই দিনে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে জš§গ্রহণ করেন। খোকা নামের সেই শিশুটি পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির ত্রাতা ও মুক্তির দিশারী। বাংলাদেশের নাম বললেই যে মানুষটির নাম আসে সর্বাগ্রে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ইতিহাসের ভাষ্যমতে দু’হাজার বছরের বেশি সময় ধরে বাংলার মাটিতে পালাবদল ঘটেছে বহু রাজা-মহারাজা-সম্রাটের। যদিও তাদের কেউই বাঙালি ছিলেন না। বিদেশি হলেও পাল বংশ, তুর্কি, পাঠান, সুলতান ঈসা খাঁ, কেদার রায় ও নবাব সিরাজ বাংলাকে ভালোবেসেছিলেন। ১৭৫৭ সালে মীরজাফরের জঘন্য ষড়যন্ত্রে পলাশীর প্রান্তরে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। এর পর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রক্তাক্ত ইতিহাস। ১৯৪৭ থেকে আবার ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নির্যাতন-নিপীড়নের ইতিহাস প্রায় ২১৪ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে শেরেবাংলা এ. কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বহু নেতা বাংলার নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ডাক কেউ দিতে পারেননি। নির্যাতন-নিপীড়নে বাঙালি যখন জর্জরিত, ঠিক সেই সময় বাঙালিকে ছুঁয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব। বাঙালির মুক্তির সুপ্ত বাসনাকে জাগ্রত করে সাত কোটি মানুষকে উপনীত করেন মুক্তির মোহনায়। কখনো ভাষার জন্য, কখনো স্বাধিকারের জন্য চলতে থাকে আন্দোলন। এসবের আড়ালে গড়ে উঠে স্বাধীনতার আন্দোলন। ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। ১৯৪৮ সাল থেকে ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফা, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় বাঙালি জাতি। এতে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের সমর্থন লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালির এই নির্বাচনে বিজয়কে মেনে নেয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাদেশ তখন অগ্নিগর্ভ। পুরো জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের। শ্রদ্ধেয় কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দীপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর জনতার মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন কবি। শুনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি/ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বজ কণ্ঠে ঘোষণা করেন স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন পুরো বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ‘৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কারাগারে আটক রেখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। মুজিব রইলেন কারাগারে। সাত কোটি বাঙালিই সেদিন ছিলেন একেকজন যোদ্ধা। ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ২১৪ বছর পর জয় হলো বাংলার। বাংলার সুনীল আকাশে পতপত করে উড়ল লাল সবুজের পতাকা। জš§ নিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন দেশ বাংলাদেশ। যার পরতে পরতে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। যার নামে সেøাগান দিয়ে দিয়ে যোদ্ধারা যুদ্ধে গেছেন। যার নামে গঠিত হয়েছিল প্রবাসী সরকার। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বীর বাঙালি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে নেয়। জš§ হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নিজের দেশে বীরের বেশে ফিরে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পুরো জাতি সেদিন দেশের ভার তুলে দিয়েছিল তাদের জাতির পিতার হাতে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়তে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কিন্তু বাংলার দুর্ভাগ্য, মীরজাফররা যুগে যুগে এদেশে থেকে যায়। ’৭১-এর পাকিস্তানি শক্তির দোসর যারা ছিল তাদের শিরোমণিরা সেদিন অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। কারো কারো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। অনেকে সাজাও ভোগ করছিল সে সময়। সেই সব রাজাকার-আলবদরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল বিপথগামী কিছু সেনা অফিসার এবং মীরজাফর খন্দকার মোস্তাক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলার জমিনে নেমে আসে কালো এক রাতের। স্তব্ধ হয়ে যায় মানবতাদের কণ্ঠস্বর। স্তম্ভিত হয়ে যায় বিবেকমান প্রতিটি মানুষ। সপরিবারে খুন হন স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। থেমে যায় হ্যামিলয়নের বাঁশিওয়ালার সুর। হায়নাদের থাবা থেকে শিশু-নারী থেকে সেদিন কেউ রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ অভিন্ন এক সত্তা। একটি ছাড়া অন্যটি কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে একক ব্যক্তি সত্বার ভেতরে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে হলে ১৭৫৭ সাল থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ নিতে হবে। শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করি।
লেখক: মানবকণ্ঠের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি