বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি শত শত বছর ধরে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে, সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে এবং তার ফলে স্বাধীনতার যে প্রত্যাশাটি উন্মুখ হয়ে উঠেছে তাকে ভাষা দিয়েছেন এবং এই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত একটি ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তিনি বাঙালি জাতির স্রষ্টা এবং এই সংগ্রামের ফলে সৃষ্ট বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও অসাধারণত্ব বহুমাত্রিক। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিচার করলেও এই ভাষণ অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। কেউ কেউ এ ভাষণকে আব্রাহাম লিংকনের 'গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস' (১৮৬৩) বা মার্টিন লুথার কিংয়ের (জুনিয়র) 'আই হ্যাভ এ ড্রিম' (১৯৬৩) ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেন। এই তুলনাকে যথাযথ মনে হয় না। ওই দুটি ভাষণের প্রেক্ষাপট আলাদা; বঙ্গবন্ধুর মতো বিপুল মানুষের আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশার চাপ এবং প্রবল শত্রুপক্ষের মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সম্ভাবনার মধ্যে তাদের ওই ভাষণ দিতে হয়নি।
তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে উইনস্টন চার্চিলের একটি ভাষণের সঙ্গেই শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছুটা তুলনা চলতে পারে। তবে সেখানেও চার্চিল শত্রুপক্ষকে আকাশে, মাটিতে এবং জলরাশিতে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন মিত্রশক্তির প্রবল শক্তিশালী অবস্থান থেকে; কিন্তু বঙ্গবন্ধু, 'আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব' কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তার জনসভাকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা পাকিসানের হানাদার বাহিনীর সর্বাধুনিক অস্ত্র, যুদ্ধ-প্রযুক্তি ও উন্নত কৌশলসমৃদ্ধ পাকিসানের সেনাবাহিনীর উদ্দেশে। তার অবস্থা ছিল নিরস্ত্র, কিন্তু বিপুল জনসমর্থনধন্য জননেতার অসম-অবস্থান। তবে জনশক্তি যেহেতু যে কোনো মারণাস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী-বঙ্গবন্ধু সেই শক্তির অবস্থান থেকেই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন। স্পষ্টতই, বঙ্গবন্ধু শত্রুর মোকাবিলা করতে বলেছিলেন। তাই চার্চিলের এবং বঙ্গবন্ধুর শত্রুর মোকাবিলার উদ্দেশ্য এক হলেও পথ ছিল ভিন্ন।
আমাদের বিবেচনায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ওইসব ভাষণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সঙ্গে একটা জাতি-গঠন প্রক্রিয়ার পূর্ণতা এবং জনগোষ্ঠীর শত শত বছরের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন ও বিপুল আত্মত্যাগের ইতিহাস যুক্ত রয়েছে। দার্শনিক হেগেল রাষ্ট্র গঠনকেই সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক কর্ম বলে আখ্যায়িত করেছেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র গঠনের এই মহৎ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন বলেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাঙালি জাতির পিতা এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি বিচারে এই ভাষণ গোটা বিশ্বেই তুলনারহিত।
দুই.
এক কঠিন সঙ্কট মুহূর্তে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-ভয়-ত্রাস এবং আশা ও সম্ভাবনায় উদ্বেল সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে মাত্র ১৯ মিনিটের এক জাদুকরী ভাষণে রাজনৈতিক চেতনার একই উত্তুঙ্গ সরে এনে স্বাধীনতার জন্য মরণপণ অঙ্গীকারদীপ্ত মুক্তিসেনানিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির মেলা ভার। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।' নেতাজী সফল হননি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে 'মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ' উক্তিকে অক্ষরে অক্ষরে বাসবায়িত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, কিশোর বয়সে তিনি সুভাষ বসুর বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে সুভাষ বসুর চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির কথা তার অবশ্যই মনে পড়ে থাকবে। শুধু মনে পড়া নয়, কিশোর বয়সে মেন্টরকে (Mentor) ছাড়িয়ে যাওয়ার বাসনাও তার মনে ছিল নিশ্চয়ই। বঙ্গবন্ধু বিপুল পাঠে অভ্যস ছিলেন।
বহু রাজনৈতিক মনীষীর জীবন ও কর্মের তিনি ছিলেন অনুরাগী পাঠক। তাই তার চার্চিল চর্চাও স্বাভাবিক ঘটনা। ফলে ৭ মার্চের ভাষণ তিনি মনে মনে তৈরি করেন, তখন লিংকন, চার্চিল ও নেতাজীর প্রাসঙ্গিক ভাষণকে অবশ্যই স্মরণ করে থাকতে পারেন। তবে ৭ মার্চের অনন্যসাধারণ ভাষণ, তার এবং শুধু তারই এক চিরকালীন মাস্টারপিস। তার একান্ত বিশ্বস বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ একান্ত সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেন, 'আগের দিন রাত ৪টা পর্যন্ত জেগে আমরা তার জন্য ৭ মার্চের ভাষণ ও তার ইংরেজি তরজমা করলাম। কিন্তু ভাষণ দেয়ার সময় দেখা গেল আমাদের প্রস্তুত করা খসড়া তার সামনে নেই এবং যে ভাষণ দিলেন তার সঙ্গে আমাদের খসড়ার কোনো কোনো পয়েন্ট ছাড়া আর কোনো মিলই নেই।'
তিন.
কী নেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সংক্ষিপ্ত ভাষণে? বাঙালি জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার ধারাবাহিক করুণ ইতিহাস আছে, তা বর্ণনা করার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া আছে আবেগ, মুক্তিপাগল বাঙালির রক্ত ঝরানোর নির্মম স্মৃতি এবং তাদের গণতান্ত্রিক আশা-প্রত্যাশার ন্যায্যতা; আছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ এবং যুক্তির জোরালো উপস্থিতি। এসব মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মানবিক বোধের শ্রেষ্ঠত্ব, গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা এবং নিপীড়িত মানুষের স্বাধিকার অর্জন ও আর্থসামাজিক মুক্তির এক অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে।
মানুষকে জাগ্রত, উদ্দীপ্ত এবং তীব্র অধিকারসচেতন ও লড়াকু মানসিকতাসম্পন্ন করার জন্য সুদক্ষ বাগ্মীরা কতগুলো কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। বঙ্গবন্ধুও তার জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তা করেছেন পরিচ্ছন্ন দক্ষতা ও সুগভীর আন্তরিকতায়। মার্কিন সাময়িকী নিউজ উইকের ভাষায়, 'রাজনীতির' এই 'কবি' ও 'প্রকৌশলী' আন্তরিক আবেগ, প্রয়োজনীয় তথ্য এবং বাংলার মানুষের ওপর নানা অত্যাচার-নির্যাতন-শোষণের নির্মমতা এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হাতিয়ারপ্রতিম, 'কি ওয়ার্ড'গুলো বারবার ব্যবহার করে নতুন ব্যঞ্জনা এবং মানুষের রক্তে বিদ্রোহের গতিবেগ সৃষ্টি করেছেন। এসব মূল কথাকে বারবার সামনে আনায় শ্রোতাদের মনে তা স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে 'মুক্তি' ও 'মুক্ত' শব্দ দুটি বেশি গুরুত্বে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণ মানুষ দুস্থ ও দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চায়। তাই তিনি তার ভাষণের চতুর্থ লাইনেই বলেছেন, 'আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়'; এবং অষ্টম লাইনেই আবার 'মুক্তি' শব্দটি এসেছে এভাবে, এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। আবার বলেছেন, 'যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে' এবং 'এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ'। তবে এই ঐতিহাসিক ভাষণের সারকথা যে বাক্যটিতে উচ্চারিত হয়েছে 'মুক্তির' কথা তাতে সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। যেমন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার স্বাধীনতা চাননি, বাঙালির মুক্তিও চেয়েছেন। ফলে এ ভাষণ একইসঙ্গে হয়েছে কালজ ও কালোত্তর।
বাংলার মানুষকে একাত্ম করার জন্য এবং নিজ ক্যারিশমানুযায়ী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে নিজ কাঁধে নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু 'আমার' শব্দটিকে বারবার ব্যবহার করেছেন। উদাহরণ, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে', 'আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে', 'ভাইয়েরা আমার', 'আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছে, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরিব, দুঃখী, নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে'; 'তার বুকের ওপর হচ্ছে গুলি', 'আমার গরিবের উপর', 'আমার বাংলার মানুষের', 'আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে', 'আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে', 'আমার মানুষকে কষ্ট দিয়েছে', 'আমার লোককে হত্যা করা হয়' ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেছিলেন, 'ভাইয়েরা আমার' বলে এবং শুরুতে বলেছিলেন 'আপনারা সবাই জানেন এবং বোঝেন'। এবং ভাষণের শেষাংশে আসতে আসতে তার কম্যুনিকেট করার আত্মীয়সুলভ ভঙ্গিতে তিনি এমন সরে পেঁৗছে গেছেন যে, তাদের সহজেই 'তুমি' সম্বোধন করতে পারছেন। এতে শ্রোতার সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে এবং তার বক্তব্যের আবেদন বেড়েছে। এতে বক্তা এবং শ্রোতা একাত্ম হয়েছেন। ভাষণের কেন্দ্রবিন্দুটি ঠিক রেখে তিনি নানা অপরিহার্য উপাদানকে গ্রথিত করেছেন। তবে ভাষণের ধারাবাহিকতাকে কখনও ক্ষুণ্ন হতে দেননি এবং কোনো পয়েন্টই মূল বক্তব্যকে শিথিল করেনি। বরং ওইসব আনুষঙ্গিক উপাদান মূল বক্তব্যকে সংহত ও জোরালো করেছে।
বাংলাদেশের মানুষের একটা স্বকীয় সত্তা ও নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। লৌকিক ভাষাভঙ্গি ও বাকপ্রতিমায় তার চমৎকার ও লাগসই প্রকাশ ঘটে। এই বিশিষ্ট সত্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য চারিত্রিক দার্ঢ্য, বিদ্রোহের মানসিকতা এবং কোনো অবস্থাতেই মাথানত না করা। বাংলার পৌরাণিক চরিত্র চাঁদ সওদাগর, সাহিত্যের চরিত্র হানিফ গাজী ও তোরাপ, কাব্যস্রষ্টা কবি নজরুল এবং মানবিক ও রাজনৈতিক চরিত্র শেখ মুজিবে আমরা এই বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় পাই। বাঙালি চরিত্রের এই বিশিষ্ট রূপের স্পর্শ পেয়ে ৭ মার্চের ভাষণে যুক্ত হয়েছে অনন্য বৈভব। বঙ্গবন্ধু তার আপসহীনতা ও চারিত্রিক দার্ঢ্যের পরিচয় মুদ্রিত করেছেন লৌকিক ভাবভঙ্গির বিশিষ্ট বুলির সংযোজনে। প্রাকৃতজনের ব্যবহৃত এসব মণিমুক্তাসদৃশ কিছু শব্দ বাঙালির ব্যবহারিক জীবন থেকে নেয়া। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর শিকড়সম্পৃক্ত বুলিসমৃদ্ধ এ রকম একটি লাইন লেখা হলো, 'সাড়ে ৭ কোটি মানুষেরে দাবায় রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।'
জনগণের প্রবল চাপ ও প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। বঙ্গবন্ধু যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন তখন জনমত সৃষ্টির দায়িত্ব প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রলীগের ওপর দেয়া হতো। অগ্রগামী দল হিসেবে যেমন 'জয় বাংলা', 'জাগো জাগো বাঙালি জাগো', 'পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা', 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়ো', 'মুক্তিবাহিনী গঠন করো', সেস্নাগান, স্বাধীনতার পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত প্রভৃতিও সুপরিকল্পিতভাবে ছাত্রলীগকে দিয়ে প্রথমে মাঠে ছাড়েন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্রলীগের তৎকালীন ক'জন বিশিষ্ট নেতাকে নিয়ে ১৯৬১ সালেই একটি গোপন নিউক্লিয়াস গঠন করেন। তাদের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের এসব উপাদান জনসমক্ষে আনা হয়। ১৯৭১-এর ৭ মার্চে নিউক্লিয়াসের তৈরি এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নামে প্রচারিত ইশতেহারে বাংলাদেশের নাম, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, মুক্তিবাহিনী গঠন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, সামরিক প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় বিষয় প্রকাশ করা হয়।
অতএব যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি না নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তারা হয় তা অজ্ঞতাপ্রসূতভাবে বলেন অথবা মিথ্যাচার করেন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রদের ওই বিসৃত ইশতেহারই বঙ্গবন্ধুর সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিন্ন ভিন্ন অংশ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পূর্ণাঙ্গ কর্মকৌশল। এ সময়ে তিনি শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-শুভানুধ্যায়ী নয়, বাম রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গেও একটা যোগাযোগ রাখতেন। এভাবে তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বসরে তিনি তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন।
১৯৬৫ সালে বায়াফ্রার Unilateral Declaration of Independence (UDI) এর কথা তার মনে ছিল। তাই তিনি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাষণে বললেন, 'অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন মার্শাল ল' Withdraw করতে হবে। সমস সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হসান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না।'
বঙ্গবন্ধুর এই চারটি শর্তকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিচক্ষণ রণকৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। আমাদের বিবেচনায় মাস্টার স্ট্রোকসমৃদ্ধ এই চারটি শর্তে তিনটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে- এক. স্বাধীনতা ঘোষণা শোনার জন্য পাগলপারা উত্তাল জনসমুদ্র একটু থমকে গেছে, তবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে যে, বঙ্গবন্ধু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যই একটি কৌশলগত ধাপ হিসেবেই এই কঠিন চারটি শর্তকে সামনে নিয়ে এসেছেন; দুই. দৃশ্যত নেতা গণতন্ত্রসম্মত ও নিয়মতান্ত্রিক পথেই আছেন এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তার এই শর্তগুলো যৌক্তিক- বহির্বিশ্বকে এমন ধারণা দেয়া।
এই শর্ত দেয়া না হলে তার 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'-এই বাক্যকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা (টউও) বলে গণ্য করা হতো। তাতে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত হতেন। ফলে আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্বজনমত দুই-ই তার বিপক্ষে চলে যেত। তাই রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও মেধাবী কৌশলবিদ হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েও তার কার্যকারিতাকে তিনি শর্তসাপেক্ষ করে রাখলেন; তিন. আমাদের ধারণা বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিসানি শাসকচক্র ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ও বিমান আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। এতে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই নিহত হতেন। স্বাধীনতার ঘোষণার শর্তযুক্ত বাতাবরণ পাকশাসকদের সেই পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর ক্ষুরধার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা ক্রোধান্ধ বুনো শুয়োরের মতো নিজেরাই একতরফা ক্র্যাকডাউনে গিয়ে গণহত্যা শুরু করায় বঙ্গবন্ধুর চার শর্ত বাতিল হয়ে গিয়ে ২৬ মার্চ থেকে তার ঘোষণা কার্যকর হয়। ২৬ মার্চ মধ্যরাতে তার স্বাধীনতার নতুন ঘোষণাটি ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
আসলে চারটি শর্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিসান দখলদার বাহিনীর ৭ মার্চের আক্রমণকে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। ওরা ওই দিন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে সব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তা না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমণ করার জন্য ইয়াহিয়া-ভুট্টো আলোচনার ছলনাময় অধ্যায়টির সূত্রপাত করেন।
ফলে পরিস্থিতি কী হবে তা কি বঙ্গবন্ধু জানতেন না? অবশ্যই জানতেন এবং তারও কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি আলোচনা চালালেন; কিন্তু জানতেন এ হবে নিষ্ফলা। সেজন্যই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুযায়ী পাকিসানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি বুঝেছিলেন, পাকিসানি চক্রান্তকারীরা তাকে এই ক্ষমতা দেবে না। তাই তিনি ওই ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।... ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।' এই বক্তব্যে তিনি 'বাংলাদেশ' শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং বলে দিয়েছেন তিনি 'প্রধানমন্ত্রী' অর্থাৎ পাকিসানের প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশে, যেজন্য কোন অফিস বন্ধ থাকবে তা যেমন বলছেন, তেমনি আঠাশ তারিখে কর্মচারীদের বেতন নিয়ে আসতে বলেছেন।
এই বক্তব্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আছে। তবে তা বাসবায়নের জন্যই আবার বলেছেন, 'তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাসাঘাট যা যা আছে সবকিছুই_ আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।' পাকিসানি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই বক্তব্য গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ। দিব্যচোখে ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েই যেন আবার স্মরণ করে দেয়ার জন্য বললেন, 'তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।' আবার সামনে আনলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।'
*শামসুজ্জামান খান
লোক গবেষক ও মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি।