Thursday, 5 March 2015

আন্দোলনের অক্টোপাসে বন্দী শিক্ষা-ভবিষ্যত্ শিক্ষা


আচরণটি নতুন নয়। নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বার্থবাদী রাজনীতি সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। সরকারি পক্ষ মনে করে জ্ঞান চক্ষুর উন্মীলন মানুষকে আত্মসচেতন করে তোলে। তাই শিক্ষিতগোষ্ঠী সরকারের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠবে। ফলে দুর্বল করে রাখতে হবে শিক্ষা কাঠামোর ধারা। বিরোধী দল মনে করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক মিলে একটি বড় জনগোষ্ঠীর বাস দেশে। যদি আন্দোলনের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সরকার ক্ষুব্ধতার মুখে পরবে। এসব নানা পক্ষের নানা সমীকরণের কারণে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষা আর শিক্ষার্থী।
এগার শতকে বিদেশি সেন রাজারা বাংলার সিংহাসন দখল করার পর প্রতিবাদী বাঙালিকে ভয়ের চোখে দেখেছে। তাই তারা চেয়েছে বাঙালির শিক্ষা সংস্কৃতির শক্তিকে দুর্বল করে দিতে। এই লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠী শূদ্র অভিধায় কোণঠাসা করে রাখা বাঙালিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতি শূন্য করে ফেলতে চেয়েছে। তাই পাপ বলে প্রচার করেছে শূদ্রের বিদ্যা শিক্ষার অধিকারকে। অনেককাল পর পাকিস্তান আমলের শুরুর পর্বে বাংলা ভাষার প্রতি শাসকদের বৈরি দৃষ্টির কারণও ছিল অভিন্ন।  মেধা ও সংস্কৃতি শূন্য করে প্রতিবাদী বাঙালিকে নির্জীব করে ফেলতে চেয়েছে।
বিএনপি জোট এবার আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে অভীষ্টে পৌঁছার চেষ্টা করছে। নেতৃত্বের হিসেবের ভুলে বিএনপির মত একটি জনপ্রিয় দলকে রাজপথ ছেড়ে ঢুকে পরতে হয়েছে চোরাগলিতে। একটি গণতান্ত্রিক দলে নিজ আদর্শিক জায়গার স্খলন ঘটিয়ে জামায়েতের জঙ্গী ফর্মূলা গ্রহণ করেছে। পেট্রোল বোমা আর ককটেলে সাধারণ মানুষকে দগ্ধ করে সরকারকে চাপে ফেলতে চেয়েছে। নিজ দলীয় নেতা নেত্রী আর সাধারণ মানুষকে এই দুর্বোধ্য আন্দোলনে মাঠে নামাতে না পেরে কিছুটা বেকায়দায় পরেছে বিএনপি নেতৃত্ব। দু’মাস অতিক্রম করেছে হরতাল অবরোধ। দিনের হিসেবে রেকর্ড করা ছাড়া এই কর্মসূচি থেকে কোনো ফলাফল লাভ করতে পারেনি। শুধু সর্বস্তরের মানুষের মনে তৈরি হয়েছে বোমাতঙ্ক আর বিএনপি নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ। বিএনপির কর্মসূচিতে পুরো বিষয়টিই লেজে গোবরে হয়ে গেছে। সাধারণভাবে জানা ছিল সরকার পতনের মত আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপ অবরোধ কর্মসূচি। জনগণের পূর্ণ সমর্থনে অবরুদ্ধ সরকার ধূলির ধরায় নেমে আসতে বাধ্য হবে। কিন্তু আমাদের চমকে দিয়ে বিএনপি নেত্রী আন্দোলনের গা গরমে না গিয়ে, কোনো ভূমিকা তৈরি না করে একেবারে উপসংহারে পৌঁছে যাত্রা শুরু করলেন। এভাবে জনগণ দূরের কথা—কর্মী সমর্থকদের প্রস্তুত না করে অবরোধের ডাক দিয়ে দিলেন। এতে যা হওয়ার কথা তাই হলো। সরকার সক্রিয় অবস্থানে থাকায় অবরোধের ডাকে সাড়া মিললো না। বাধ্য হয়ে স্নাতকের ছাত্রের পুনরায় উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির দশা হলো। অবরোধের ভেতর লাগাতার হরতাল চাপিয়ে দিতে লাগলেন। এমন গোজামিলের ফলাফলও ভালো হয় না। দিনে দিনে হরতাল অবরোধের আবেদন বা ভীতি ফিকে হয়ে যেতে লাগলো। রাজধানীতে প্রভাব শুরু থেকেই ছিল না। মাঝে মাঝে চোরাগোপ্তা বোমা হামলা ছাড়া হরতাল বোঝার কারণ ছিল না। প্রথম দিকে ব্যবসায়ী আর কৃষকদের সংকট ছিল। বোমা ভীতির কারণে দূরপাল্লার পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করতে পারেনি। ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাস আক্রান্ত হয়েছে। জনসমর্থন না থাকায় এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতায় দূরপাল্লার যানবাহন চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফলে এখন চোরাগোপ্তা বোমা হামলা ছাড়া দৃশ্যত দেশে হরতাল অবরোধের তেমন প্রভাব নেই। তাই শেষ আক্রমণ এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর।
বিএনপি জামায়াতের প্রথম থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের জিম্মি করা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আঘাতহানার দিকে ঝোঁক ছিল বেশি। ২০১৪-এর নির্বাচন ঠেকাতে ২০১৩-এর ডিসেম্বরে শতাধিক স্কুলে আগুন দিয়েছিল বিএনপি জামায়াত। এবারও প্রথম দিকে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় কোমলমতি শিশুদের হরতালের বন্দিত্বে ফেলা হয়েছিল। আর এখন কোনো ক্ষেত্রে হরতালের প্রভাব ফেলতে না পেরে জিম্মি করার চেষ্টা করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর শিক্ষার্থীদের। একটি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা নিজ রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন বিপন্ন করে এমন উদাহরণ হয়তো আর কোথাও পাওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের একটি বড় সোপান এসএসসি পরীক্ষা। এই পরীক্ষাকে নির্বিঘ্ন করার দায়িত্ব দেশের সকল দায়িত্ববান পক্ষের। অথচ বিএনপি যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে এসএসসি পরীক্ষা ভণ্ডুল করতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক ৭২ ঘন্টার জেরে পরীক্ষার সময়সূচি পরিবর্তন করে নতুন তারিখ দিচ্ছে। সাথে সাথে নতুন তারিখকে পিছু ধাওয়া করছে আন্দোলনকারীরা। নতুন তারিখের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে আবার হরতাল। তারা বুঝে গেছে আর কেউ হরতাল না মানলেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে পরীক্ষা বাতিল করতেই হবে। রাজনীতি যখন লোভে আর মূর্খতায় বন্দী হয় তখন শিক্ষার ওপরই আক্রমণ করে। আন্দোলনকারীরা একবারও ভাবলো না পরীক্ষা দেয়ার যে স্বাভাবিক প্রস্তুতি থাকে তাকে নষ্ট করে পনের লক্ষ কোমলমতি শিক্ষার্থীর কতটা ক্ষতি করলো তারা। অনেক স্কুল খোলা থাকলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে সকল অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। এতে ভেঙ্গে পড়ছে শিক্ষা শৃঙ্খলা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেশিরভাগ কলেজ খোলা থাকলেও শতভাগ শিক্ষার্থী আসতে পারছেন না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এখন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর প্রায় ৬০ ভাগ পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল সুবিধা নেই। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাজনিত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ ক্লাস বন্ধ রেখেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় সেমিস্টার পদ্ধতিতে পড়ালেখা হয় বলে একাডেমিক ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী প্রতিটা দিন হাতেগোনা। এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে অভিভাবকদের আর্থিক ক্ষতি যেমন হচ্ছে তেমনি শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। সম্প্রতি হরতালের দু’মাস পূর্তি হওয়ার পর দেয়ালে পিঠ ঠেকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা শৃঙ্খলা নিয়ে ইউজিসি বৈঠক করেছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে এখন থেকে হরতাল অবরোধে ক্লাস হবে। তবে এর মধ্যে যে ক্ষতি হওয়ার তা ফিরে পাওয়ার  নয়।
সবকিছুরই শেষ আছে। বিএনপি জোটেরও জনসমর্থনহীন এই আন্দোলননামীয় কর্মসূচির অবসান হবে। আবার রাজনীতির ময়দানে হাঁটতে হবে। তবে ক্ষমতার সিঁড়ি পেতে স্বার্থপরের মত দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন নিয়ে যেভাবে বিএনপি জোট তস্করের আচরণ করলো সে কারণে প্রশ্নের মুখোমুখি বিএনপি নেতাদের হতেই হবে। তখন খুব সহজ হবে না সে প্রশ্নের উত্তর দেয়া।

লেখক :ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ,অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
shahnawaz7b.gmail.com