মাহ্ফিল সংস্কৃতিতে দরসুল কোরআন
মাহ্ফিল শব্দটি আরবী। এর অর্থ সভা, সমাবেশ, জমায়েত, অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এতদ্ অঞ্চলের মানুষের পরিভাষায় সাধারণত ইসলামী সভা-সভাবেশ বুঝাতে মাহ্ফিল শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে; যাতে ইসলামী আক্বীদা (ধর্মীয় বিশ্বাস) ও আমল-আখলাক সম্পর্কে সংশিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করে থাকেন এবং শ্রোতারা ধর্মীয় বিধি-নিষেধ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে তা বাস্তবায়নের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে। মাহ্ফিল সংস্কৃতি বলতে সাধারণত ধর্মীয় সমাবেশ বুঝালেও এর প্রচলন কিন্তু বহু পুরানো। কোন বিষয়ে মানুষকে অবহিত করতে তাদেরকে সুনির্দিষ্ট পন্থায় আহ্বান করে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়াই হল এ সংস্কৃতির মুল লক্ষ্য। কালের আবর্তনে এর আঙ্গিক, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া ভিন্ন হলেও যুগে যুগে এটি চালু ছিল। কুরআন-হাদীসের বাচনভঙ্গি থেকেও বুঝা যায় যে, এ সংস্কৃতি আল্লাহ্ তায়ালাই চালু করেছেন। যেমন, তিনি আত্মার জগতে সকল মানবের সমাবেশ করে তাদের থেকে নিজের রবুবিয়্যতের স্বীকৃতি নিয়েছেন এবং সকল নবী (আ.) এর সমাবেশ করে তাঁদের নিকট থেকে শেষ নবীর আনুগত্যের স্বীকৃতি নিয়েছেন। নবীগণও দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে স্ব-স্ব যুগে তাদের উম্মতদের নিয়ে মাহ্ফিল করেছেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ছালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম তাঁর চল্লিশ বছর বয়সে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হলে তৎযুগের নিয়মানুযায়ী আবু কুবাইস পাহাড়ের পাদদেশে স্বজাতির সমাবেশ করে সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করেন। পরবর্তীতে জুমার নামাযের বিধান অবতীর্ণ হলে জুহরের নামাযকে দু’রাকাত করে তদস্থলে খুতবা বা ধর্মীয় বক্তব্য প্রদানকে আবশ্যক করা হয়। এ খুতবা হল দেশের আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কুরআন-হাদীসের দৃষ্টি ভঙ্গি মুসলিমদের সামনে ব্যাখ্যা করা ও সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ প্রদর্শন করা। এভাবে জুমার নামাজকে উপলক্ষ করে মূলত: প্রতি জুমায় মুসলমানদের সাপ্তাহিক মাহ্ফিলের আয়োজন করা হয়। রাসুলুলাহ ছালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম জুমার নামাজ ছাড়াও বিভিন্ন সময় তাঁর ছাহাবাগণকে নিয়ে মাহফিল করতেন। আল-কুরআনের সূরা আয্যারিয়াতের ৫৫ তম আয়াতে বলা হয়েছে, “আপনি তাদেরকে উপদেশ দিন, কেননা, উপদেশ মুমিনদের কাজে আসে।” অতএব মাহ্ফিলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কারো দ্বিমত নেই। তবে দ্বিমত রয়েছে মাহ্ফিলের পদ্ধতি, উপস্থাপনাশৈলী, বক্তার যোগ্যতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে।দরসুল কুরআন মানে আল-কুরআনে পঠন-পাঠন, আলোচনা, ব্যাখ্যা করণ ও শিক্ষাদান। কালের আবর্তনে জ্ঞানের দৈন্যতার কারণে তাফসীরুল কুরআনের পারদর্শী ব্যক্তির অভাবে পরবর্তী আলেম সমাজ তাফসীর-এর পরিবর্তে ‘‘দরস’’ শব্দটি ব্যবহার করে আসছেন। অপরদিকে সাধারণ মানুষের সামনে তাফসীর বা কুরআনের তাত্ত্বিক বিশেষণ যেমন অসার, তেমনি আল-কুরআনের বাণীকে কোন শ্রেণী বা গোষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখাও সংকীর্ণতার নামান্তর। কেননা, আল-কুরআনের আবেদন সার্বজনীন। হুদাল লিন্নাস বা সমগ্র মানব জাতির হেদায়তের জন্য এর অবতরণ। এই দিক বিবেচনায় ধারাবাহিকভাবে আল-কুরআনের সূরারগুলোর মর্মবাণী মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছিয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে সেবা মূলক সংস্থা ‘আঞ্জুমানে খুদ্দামুল মুসলেমিন বাংলাদেশ’ ব্যবস্থাপনায় বিগত ২০০৪ সাল থেকে চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ ময়দান থেকে দরসুল কুরআনের যাত্রা শুরু হয়। এ বছর উক্ত মাহফিলের এক যুগপূর্তি মাহফিল অনুষ্টিত হচ্ছে। এই মাহফিলে বিষয় ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার পাশাপাশি দ’ুজন বিশেষজ্ঞ আলেম নির্দিষ্ট সূরার উপর দরস পেশ করেন। ২০০৮ সাল থেকে চট্টগ্রামের গন্ডি পেরিয়ে এই মাহফিল দেশের প্রত্যেকটি বিভাগে অনুষ্টিত হচ্ছে। মাহফিলের আয়োজক সংস্থা পরবর্তীতে প্রত্যেকটি জেলা শহরে বছরে অন্ততঃ একবার এই মাহফিল আয়োজন করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যুগোপযোগী বক্তব্য ও মাহফিলের ধারাবাহিকতার কারণে এ মাহফিল ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠির কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কর্তৃপক্ষ তাঁদের বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী মাহফিলের আয়োজন অব্যাহত রাখতে পারলে এর মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ হেদায়তের সঠিক দিক নির্দেশনা পাবেন বলে আশা করা যায়।
দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। আদর্শ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও তাদেরকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। অধিকাংশ ফরজ, ওয়াজিবের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর দায়িত্ব ও অধিকার সমান। যেমন ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদির ক্ষেত্রে উভয়ের দায়িত্ব সমান। জ্ঞান অর্জন করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ তথা শিক্ষার অধিকারের ক্ষেত্রে উভয় সমান। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী-সমাজের ধর্মশিক্ষা সনাতন পদ্ধতির মকতব ব্যবস্থাপনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মকতব পরবর্তী জীবনে পুরুষদের ধর্ম শিক্ষার বহু সুযোগ থাকলেও নারী সমাজের জন্য এই সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। যারা মাদরাসা বা স্কুল-কলেজে পড়ে না, তাদের অবস্থা আরও নাজুক। অথচ কুরআন-সুন্নাহর প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন ও তদানুযায়ী আমল করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য সমানভাবে ফরজ। সুতরাং নারীদেরকে বাদ দিয়ে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের চিন্তা করা যেমন অসম্ভব, তেমনি ধর্মীয় জ্ঞানে তাদেরকে আলোকিত করা ব্যতীত ইসলামী পরিবার ও সমাজ গঠন করাও অসম্ভব। তাই পুরুষের পাশাপাশি নারী সমাজের কাছে কুরআন-সুন্নাহর আলো বিতরণ করার লক্ষ্যে দরসুল কুরআন মাহফিলে পর্দাসহ যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ পূর্বক তাদের আগমণের সুযোগ করে দেয়ার সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলা যায়। আরো লক্ষণীয় বিষয় হল, বিগত ২০১৪ সাল থেকে মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র মাহফিল আয়োজন করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রথম দিবস শুধু মা-বোনদের জন্য আর দ্বিতীয় দিবস পুরুষদের জন্য আয়োজন করা হচ্ছে।
একটা মাহফিলের মূল সফলতা হল-এর মাধ্যমে হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়া। হেদায়েতের মালিক আল্লাহ তায়ালা। তবে মাহফিলের আয়োজক ও বক্তার এখলাছ হেদায়েত প্রাপ্ত হওয়ার জন্য বড় উছিলা। এটাও অস্বীকার করার জো নেই যে, তথ্য ও তত্ত্বনির্ভর আলোচনা এবং চমৎকার ভাষাশৈলী শ্রোতাদের প্রভাবিত করার অন্যতম উপায়। এ দিক থেকে দরসুল কোরআন মাহফিলের পদ্ধতি যুক্তিসঙ্গত। কারণ, এখানে প্রত্যেক বক্তাকে আলোচনা করতে হয় স্বদেশী ভাষায়; যে ভাষার জন্যই আমাদের দামাল ছেলেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন। আবার যেহেতু মাহফিলের আসল উদ্দেশ্য সাধারণ শ্রোতামন্ডলী, সেহেতু তাদের কাছে মাতৃভাষাই সহজবোধ্য। সুতরাং মাতৃভাষায় কুরআন-সুন্নাহর আলোচনা করাই অধিক যুক্তিসঙ্গত। দরসুল কুরআন মাহফিলের উদ্দেশ্য হল, দল-মত নির্বিশেষে সকলের নিকট ইসলামের সঠিক আক্বিদা ও আমলের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া এবং এর মাধ্যমে ইসলামী অনুশাসনের প্রতি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। এই উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে প্রয়োজন যুগোপযোগী আলোচনা; যা সকল শ্রেণীর মানুষকে আলোর দিশা দিতে পারে। এ লক্ষ্যেই মাহফিল কর্তৃপক্ষ বক্তাদের কাছে একটি নীতিমালা পেশ করেন। যার সারাংশ হল নিজের নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর সাথে সঙ্গতি রেখে সহনশীল মনোভাব নিয়ে দলিলাদির আলোকে বিজ্ঞান সম্মত বক্তব্য পেশ করা। বর্তমান ফিতনার যুগে এই নীতিমালা এবং এর চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
লেখক : মুহাম্মদ নুর হোসাইন,সহকারী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।